#Pravati Sangbad Digital Desk:
চলচ্চিত্র, সাহিত্য এবং বঙ্গ সংস্কৃতি এই ত্রিধারার মেলবন্ধন ঘটিয়ে যাঁর সৃজনশীলতা সারা বিশ্বকে সম্মোহিত করেছে, যে নাম বাঙালির কাছে শুধু একজন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বের নাম নয়, আবেগও বটে, তিনি সত্যজিৎ রায়। বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী তাঁর পিতামহ। আর এক কিংবদন্তি সুকুমার রায় তাঁর পিতা। সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও শৈশব সুখকর ছিল না। মাত্র দুই বছর বয়সে পিতৃহারা হন। কিন্তু সত্যজিতের মা ছিলেন দৃঢ়চরিত্র মহিলা। দেশের প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের সদস্যা। পরবর্তীকালে সত্যজিতের শৈল্পিক ভাবনা ও চলচ্চিত্রে নারীরা যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা প্রকাশ পেয়েছিল। ১০০ বছরে পা দিলেন সত্যজিৎ। সত্যজিৎ রায় এই নামটাই যথেষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক, লেখক, গ্ৰাফিক্স ডিজাইনার অর্থাৎ সর্বগুনসম্পন্ন একজন মানুষের সমার্থক হিসেবে। তিনি নিজেই একজন ব্র্যান্ড হিসেবে সর্বদা স্মরনীয় হয়ে থাকবেন আপামর বাঙালির মনের মণিকোঠায়। তাঁর প্রথম সিনেমা 'পথের পাঁচালী', যা ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটই পালটে দিয়েছিল। 'পথের পাঁচালী', 'অপরাজিত', এবং 'অপুর সংসার' 'অপু ট্রিলজি' নামে বিশ্বদরবারে এখনও সমাদৃত। তিনি যেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের নতুন দিশা তৈরি করার ঈশ্বরপ্রদত্ত গুরুদায়িত্ব পেয়েছিলেন জন্ম থেকেই। শুধু চলচ্চিত্র নয়, তাঁর লেখা ছোটোগল্প, উপন্যাসগুলি আমাদের সময় যাপনের আদর্শ সঙ্গী। তাঁর সৃষ্ট দুই চরিত্র ফেলুদা এবং প্রফেসর শঙ্কু সত্যজিৎ রায়ের অনন্য কীর্তিগুলির মধ্যে অন্যতম। বিজ্ঞাপন সংস্থায় ৮০ টাকা বেতনের চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। তারপর একটি প্রকাশনা সংস্থার জন্য বইয়ের প্রচ্ছদ ডিজাইন শুরু করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পথের পাঁচালী'-র প্রচ্ছদের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তখনই মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলেন সুযোগ পেলেই 'পথের পাঁচালী'-র এই গল্প নিয়েই সিনেমা বানাবেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন ক্যালিগ্ৰাফিতে পারদর্শী। তিনি নিজে চারটি ক্যালিগ্ৰাফি আবিষ্কার করেছিলেন যার মধ্যে দুটি আন্তর্জাতিক স্তরের প্রতিযোগিতা জিতেছিল। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোতে গ্ৰামের প্রান্তিক মানুষের জীবনের দারিদ্র্য-দুঃখ-কষ্টের চিত্র জীবন্ত হয়ে পর্দায় ফুটে উঠেছে। 'পথের পাঁচালী' সিনেমাতে অপু ও দুর্গার শিশুসুলভ সরলতা, দারিদ্র্যের মাঝেও নিজেদের শৈশবকে উদযাপন- সাবলীলভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা হয়ত সত্যজিৎ রায় ছাড়া আর কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। তিনি ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার 'দাদাসাহেব ফালকে' পুরস্কার এবং ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার 'ভারতরত্ন' সহ অনেক পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন। শুধু ভারতে নয়, তিনি ছিলেন বিশ্বদরবারে সমাদৃত। তিনি ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক 'লেজিওঁ অফ অনার'-এ ভূষিত হন। সমালোচকেরা বলেন তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা প্যাটার্ন ছিল না। 'অপু ট্রিলজি', 'নায়ক', 'গুপী গাইন', 'বাঘা বাইন', 'জয় বাবা ফেলুনাথ'- সবগুলো ছবিই একে অপরের থেকে আলাদা। আর সে জন্যই তিনি সত্যজিৎ রায়, স্নিগ্ধ ব্যতিক্রমী। তিনি কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যক দর্শকের কথা মাথায় রেখে ছবি বানাননি, কিন্তু তাঁর বানানো ছবি দেখে শিশু থেকে বৃদ্ধ, আপামর বিশ্ববাসীকে তার দর্শক হতে বাধ্য করেছেন। সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রতিটি ছবিতে আধুনিক মনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন। এটা বলাই যায় যে তিনি ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের আধুনিকতার পথিকৃৎ। যেমন- 'ঘরে-বাইরে' সিনেমাতে দেশের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় মুসলিম ও হিন্দুদের বিভাজন এবং সেইসঙ্গে উদারতাবাদ বনাম জাতীয়তাবাদের প্রবনতা কে স্পর্শ করেছেন। কিন্তু 'ঘরে-বাইরে' একটি অত্যন্ত রাজনৈতিক চলচ্চিত্র যার আকর্ষণীয় এবং বিতর্কিত বিষয়গুলি একটি রোমান্টিক প্লটের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে। ছবিটির কেন্দ্রবিন্দু বিমলা চরিত্রটি যে স্বাধীন এবং ভাবনা ভাবতে শিখেছিল। যেখানে, তৎকালীন সমাজের নারীরা অত্যন্ত সংরক্ষণশীল ছিলেন, সেখানে বিমলা চরিত্রটিকে বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও অন্য পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার মতো আধুনিক ভাবনা সত্যজিৎ রায় ভেবেছিলেন। তার দেখানো পথ ধরেই পরবর্তীকালে অনেকে নারীদের এই স্বাধীন মনোভাবকে প্রাধান্য দিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন। এখানেই সত্যজিৎ রায় অনন্য, আধুনিক। আপাতদৃষ্টিতে শিশু-কিশোরদের জন্য নির্মিত 'হীরকরাজার দেশে' তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। যে ছবির অন্তর্নিহিত বার্তা আজও ভীষনভাবে প্রাসঙ্গিক ও সমাযোপযোগী। সত্যজিৎ রায়ের করে যাওয়া সমস্ত কাজ আমাদের কাছে উপহারস্বরূপ। এই উপহার গুলো আমাদের মনের ফ্রেমে সর্বদা বাঁধানো থাকবে। এই ফ্রেমে কোনোদিন ধুলো জমবে না। ১০০ তম জন্মবার্ষিকীতে সত্যজিৎ রায়কে শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর লেখনীই ভরষা, "মহারাজা, তোমারে সেলাম"।
#Source: online/Digital/Social Media News # Representative Image
Journalist Name : সম্প্রিতি গোলে