হারিয়ে যাওয়া ভারতীয় সুপারস্টার

banner

#Pravati Sangbad Digital Desk:

"৩-২-৫ ফর্মেশনে স্টেবল ডিফেন্স হওয়ায় আক্রমণের ঝাঁঝ বাড়িয়ে দিল ভারত। খেলা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই কান্নান গতি বাড়িয়ে বাঁ দিক দিয়ে ঢুকে এলেন, গোলকিপারকে সামনে পেয়ে বলটা ঠেলতে গেলে গোলকিপার বলটা গ্রিপ করতে গিয়ে হালকা রিবাউন্ড হল শরীর থেকে, সাথে সাথে দুজনের মাঝখান থেকে আবার ছিটকে বেড়িয়ে এলেন নেভিল ডিসুজা এবং টোকা মেরে বলটা জড়িয়ে দিলেন জালে আর সাথে সাথে অলিম্পিকের ইতিহাসে প্রথম কোনো খেলোয়াড় হিসেবে অভিষেক ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করার বিরল রেকর্ড করে ফেললেন তিনি। এছাড়া প্রথম এশিয়ান ফুটবলার হিসেবেও অলিম্পিকে প্রথম হ্যাটট্রিক করলেন নেভিল। ৬৪ বছর পরেও অলিম্পিকের ইতিহাসে সোনার হরফে লেখা হয়ে আছে নেভিল ডিসুজার নাম। পাশে ভারতের পতাকা। সাইডলাইন থেকে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন রহিম স্যার। পুরোদলটাই যেন সেদিন অন্যমাত্রায় ফুটবল খেলেছিল যা হয়ত সকলেরই কল্পনাতীত ছিল। ম্যাচে কিন্তু আর অস্ট্রেলিয়াকে ফেরার সুযোগই দিল না ভারত বরং ৮০ মিনিটে অনেকটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে ২৫গজ দৌড়ে কিপারের মাথার ওপর দিয়ে লব করে দলের চতুর্থ গোলটা করে গেলেন কিট্টু। ৪-২ গোলে এগিয়ে গেল ভারত। কিন্তু খেলা শেষ হবার আগেই পিকের পায়ে ভয়ংকর ক্র্যাম্প দেখা দিল। সাইডলাইনের পাশে বসে গেলেন তিনি। সেই ক্র্যাম্প এতই ভয়ানক হল যে ম্যাচের পর মেলবোর্ণের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু খেলার শেষ বাঁশি বাজতেই ঐ ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে যেন সব ব্যাথা তুচ্ছ হয়ে গেল। প্রথম এশিয়ান দেশ হিসেবে অলিম্পিকের সেমিফাইনালে পৌঁছল ভারত। এশিয়ার বাকি দেশ গুলোর মধ্যে জাপান ০-২ গোলে হেরে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার কাছে, থাইল্যান্ড ১-৯ গোলে হেরে গেছিল গ্রেট ব্রিটেনের কাছে সেখানে এশীয় দল হিসেবে সকলকে চমকে দিল ভারত।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়া মেনে নিতে পারল না এই হার। ঘরের মাঠে ভারতের মতো ফুটবলের অনামী দেশের কাছে ৪-২ হারটা ক্ষত হয়ে গেল অজি রক্তের কাছে। তাঁরা ম্যাচের শেষ দিক থেকেই রি-ম্যাচের দাবী জানাতে থাকেন। বলা হয় দুটো গোল বাতিল করে ইচ্ছাকৃত তাঁদের হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিডনীতে রি-ম্যাচের জন্য তাঁরা চিঠি পর্যন্ত দেন। তবে অফিশিয়াল খেলা না হলেও শোনা যায় সিডনিতে একটা প্রদর্শনী রি-ম্যাচ অজিদের সাথে খেলে ভারত এবং সেখানেও ৭-১ গোলে তাঁরা হারিয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়াকে।
ম্যাচের পর রহিম সাহেবের স্ট্র্যাটেজি আলোড়ন ফেলল মিডিয়ায়। বিখ্যাত ফুটবল বিশ্লেষক উইলি মিসল সরাসরি বলে দিলেন ভারতীয় ফুটবলে একটা বিপ্লব হচ্ছে। রহিম স্যার বিশ্বের বহু জায়গা থেকে সম্মানিত হলেন ভারতকে ঐ প্রথমবার আধুনিক ফুটবল খেলানোর জন্য। ফিফা প্রেসিডেন্ট স্যার স্ট্যানলি রাউস ভারতের ড্রেসিংরুমে এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে গিয়েছিলেন।

৩-২-৫ স্ট্র্যাটেজি বন্দিত হল। এশিয়ায় এমন ফুটবল এর আগে খেলানো হয়নি, রহিম যে কতখানি দূরদর্শী ছিলেন তা বোঝা যায় যখন তিনি ৩-২-৫ কে পালটে কিছুদিন পর ৪-২-৪ করে দিয়েছিলেন এবং কখনো সমর ব্যানার্জি কখনো নিখিল নন্দীকে উইথড্রল স্ট্রাইকার হিসেবে খেলাতেন। এই আধুনিক ফর্মেশনে ব্রাজিল খেলেছিল ১৯৫৮ সালের সুইডেন বিশ্বকাপে যার আপফ্রন্টে খেলেছিলেন পেলে-জাগালো-গ্যারিঞ্চার মতো মহাতারকারা।
ভারতের জয় স্বচক্ষে দেখেছিলেন ডিউক অফ এডিনবার্গ, তিনি শুভেচ্ছা জানান ভারতীয় দলকে। সবচেয়ে ডিসিপ্লিনড ফুটবল খেলার জন্য সম্মানিত হয় ভারত। ম্যাচের পর মেলবোর্ণের আকাশটা দেখে পিকের মনে হচ্ছিল যেন জামশেদপুরের আকাশ, সেখানের স্বপ্নের কুঁড়িগুলো ফুল হয়ে ফুটে রঙে রঙে ভরিয়ে দিয়েছে শুধু…"

নেভিল ডিসুজা নামটা বললেই হয়ত আজ আর চিনবেন না অনেকে। এশিয়াতে, খুব জোর দিয়েই হয়ত বলছি তবু এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস এশিয়াতে নেভিল ডিসুজার মানের স্ট্রাইকার ভারতবর্ষ জন্ম দিয়েছে এ আমাদের গর্বের কারণ বটেই। কেরিয়ারের পরবর্তী সময়ে ভারতীয় দলের দীর্ঘকালীন অন্তর্বর্তী কোচ বাঘা সোম নেভিলকে মাঠে নামাতেন না, এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে কিন্তু নেভিল একদিন অভিমান করে বলেছিলেন- " কেষ্ট মিত্রের তো চোট, আমাকে নামিয়েই দেখুন না, চ্যালেঞ্জ করছি গোল না করতে পারি গোল করিয়ে দেব"- কথা রেখেছিলেন তিনি। ম্যাচটা ছিল বার্মার সাথে, পিকেকে দিয়ে জোড়া গোল করিয়েছিলেন নেভিল। দূর্ভাগ্যের বিষয় ভারতের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্ট্রাইকার শেষের দিকে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে খেলা ছেড়ে দিলেন। একমাত্র ভারতীয় হিসেবে অলিম্পিকের সর্বোচ্চ গোলদাতা হবার বিরল রেকর্ডটা আজও নেভিলের পকেটে। ১৯৫২ হেলসিঙ্কি অলিম্পিকের পর সাহু মেওয়ালাল-শৈলেন মান্না-পদ্মোত্তম ভেঙ্কটেশ-সাত্তারের মতো তারকাদের এক ধাক্কায় দল থেকে বের করে এক ঝাঁক তরুণ খেলোয়াড়কে নিয়ে এসেছিলেন  রহিম সাহেব। তুমুল বিতর্কের মাঝেও এই মানুষটি ১৯৫৬ অলিম্পিকে দলের গড় বয়স রেখেছিলেন ২৩ বছর, আর এই দলটাই ভারতের স্বর্ণযুগের দল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল পরের ৮ বছর। পিকে-কিট্টু-কেম্পিয়া-নেভিল-বলরাম-থঙ্গরাজের মতো এক ঝাঁক নতুন খেলোয়াড়। ১৯৫৬ তে চুনী দলে সুযোগ না পেলেও পরের বছরই এই দলে রাইট ইন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান চুনী গোঁসাই। তবু এই দলের সবচেয়ে মেঘে ঢাকা তারার নাম আমার মনে হয় নেভিল ডিসুজা, মুম্বই-এর নেভিলকে আটকাতে সেমিফাইনালে রীতিমতো থতমত খেয়ে গিয়েছিল স্লোভাকিয়া দল। ভারতকে গোল করে এগিয়েও দেন তিনিই, দূর্ভাগ্য যে ভারত সেদিন আর জিততে পারেনি, তাই অলিম্পিক পদকটা চিরদিনের জন্য হাতছাড়া হয়ে গেল হয়তো। কিন্তু আগের অলিম্পিকে রূপোজয়ী কিংবা ১৯৩০ বিশ্বকাপের চতুর্থ স্থানাধিকারী স্লোভাকরা খেলার শেষে পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন এক ভারতীয় ফুটবলারের- তিনি নেভিল ডিসুজা -আমরা কালের নিয়মে ভুলেই গেছি যাকে, বা বাংলাদেশের সাথে ড্র করাটাকেই স্বাভাবিক করে দেওয়ার জন্য স্ট্র‍্যাটেজিকালি ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

Journalist Name : Avijit Das

Related News