আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মী দেবীর আরাধনায় মেতে ওঠে সারা বাংলা

banner

#Bengal:

আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মী দেবীর আরাধনায় মেতে ওঠে সারা বাংলা

এসো মা লক্ষ্মী, বসো ঘরে। দুর্গোৎসব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিদের ঘরে ঘরে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। দুর্গা পুজোর পর আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মী দেবীর আরাধনায় মেতে ওঠে সারা বাংলা। তবে এ রাজ্যের পাশাপাশি ত্রিপুরা,অসম ও ওড়িশাতেও এই পুজোর চল রয়েছে। এই পূর্ণিমাকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে '‌শারদ পূর্ণিমা’‌ও বলে।

এ বছর কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো ২দিন ধরে হবে। ১৯ এবং ২০ অক্টোবর। ১৯ অক্টোবর সন্ধ্যা ৭টা বেজে ০৩ মিনিটে শুরু হবে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর তিথি যা শেষ হবে ২০ অক্টোবর রাত ৮টা বেজে ২৬ মিনিটে। এই সময়ের মধ্যে মা লক্ষ্মীর পুজো-অর্চনা করা যাবে। তবে এই সময়কালের মধ্যেও শুভ সময় হল রাত ১১টা ৩৫ মিনিট থেকে ১২টা ২৭ মিনিট পর্যন্ত।

লক্ষ্মীপুজো মানে বাংলার ঘরে ঘরে আলপনা। লাল মেঝেতে খড়িমাটি বা চালের গুঁড়োর শ্বেতশুভ্র আলপনার চল অতি প্রাচীন। লক্ষ্মীঠাকুরের আরাধনায় জাঁকজমক থাকে না, থাকে ঘরোয়া আয়োজন। শাঁখ-উলুধ্বনিতে গৃহকর্ত্রীর হাতেই পূজিত হন দেবী। ধূপ-ধুনো-প্রদীপ জ্বেলে অত্যন্ত ঘরোয়া উপায়ে ছিমছাম পুজো সারা হয়।

কথিত আছে, যে ভক্ত সারা রাত নিষ্ঠাভরে জেগে থাকেন দেবীর অপেক্ষায়, দেবী তাঁর ঘর আলো করে আসেন। চুপচাপ তিনি পুজোর ঘরে প্রবেশ করেন চৌকাঠ পেরিয়ে। লক্ষ্মীর পায়ের প্রতীকী ছাপও তাই থাকে আলপনায়। হাঁটার সময়ে দু’ধারে ছড়িয়ে দেন ধানের শিষ, যা ধন-সম্পত্তির প্রতীক।


মা লক্ষ্মী ধনসম্পদ, অর্থ ও বাড়িতে শান্তি নিয়ে আসার দেবী। লক্ষ্মী বড় চঞ্চলা, তাই তাঁকে ভক্তিভরে পুজো করার চল রয়েছে প্রতিটি বাঙালির ঘরে ঘরে। লক্ষ্মীকে সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির দেবী বলেও মনে করা হয়। সাধারণত, প্রতি বৃহস্পতিবারই বাঙালি রমণীরা লক্ষ্মীদেবীর পুজো করেন। একে নিত্য লক্ষ্মী দেবীর পুজো বলা হয়। তবে আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমা তিথিতে যে লক্ষ্মীর পুজো করা হয় তা হল কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো।

সাধারণত লম্বা আঁকাবাঁকা রেখায় ধান আঁকা হয়, তার চারপাশে থাকে ধানের শিষ। আর তার দু’পাশেই শোভা পায় মা লক্ষ্মীর পা।

কোজাগরী মূলত পূর্ব বঙ্গের মানুষদের লক্ষ্মীপুজোর দিন।


মা লক্ষ্মী ঢাক-ঢোলের আড়ম্বর পছন্দ করেন না। তাই তাঁর আরাধনায় কেবল শঙ্খধ্বনিই থাকে। দেবীর হাতে থাকে পদ্ম। আলপনাতেও এই দু’টি থাকে প্রতীক হিসাবে।

 তবে ফুল-লতা-পাতা মিলিয়ে অনেক সূক্ষ্ম নকশা দেখা যায় আলপনায়।

মা লক্ষ্মীর বাহন হল পেঁচা। তিনি আসেন পেঁচায় চড়ে, তাই তার নামও লক্ষ্মীপেঁচা। পেঁচা শুভ কাজের প্রতীক। লক্ষ্মীপুজোর আলপনাতে তাই পেঁচা আর একটি জনপ্রিয় প্রতীক হিসাবে থাকে।


আশ্বিন ছাড়াও লক্ষ্মী দেবী পূজিত হন ভাদ্র সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি ও চৈত্র সংক্রান্তিতে। এছাড়াও কালীপুজোর দিন বা দীপাবলীতে মা লক্ষ্মীর পুজো হয়। কোজাগরী পূর্ণিমার দিন ঘরে ঘরে পূজিত হন মা লক্ষ্মী। ধন, যশ, খ্যাতি, সুস্বাস্থ্যের জন্য দেবী লক্ষ্মীর আরাধনায় মেতে ওঠে বাংলার প্রায় প্রতিটা পরিবার।

লক্ষ্মীপুজোর ক্ষেত্রে আলপনা শুরু হয় দরজা থেকে, কারণ তুষ্ট হলে দরজা দিয়ে চৌকাঠ পেরিয়ে দেবী আসেন। সেই চৌকাঠের চার পাশে আঁকা থাকে দেবীর পা ও ধানের ছড়া। সাধারণত ছোটর মধ্যে লম্বাটে হয় এই আলপনাগুলি। লক্ষ্মীর পা আঁকা থাকে ঘট বা প্রতিমা পর্যন্ত। ঘটের সামনে থাকে মূল আলপনা। সেটি চক্রাকার হয়। তবে এখন চৌকো ধরনের আলপনাও আঁকা হয়। এই লক্ষ্মীপুজোকে কেন কোজাগরী বলা হয় তা জানা আছে কি?‌ আসলে কোজাগরী শব্দের উৎপত্তি ‘‌কো জাগতী'‌ থেকে, যার অর্থ ‘‌কে জেগে'‌?‌ কথিত রয়েছে, কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিনে দেবী স্বর্গ থেকে ধরিত্রীতে নেমে আসেন এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে সকলকে আশীর্বাদ দেন।


এদিন লক্ষ্মীর মূর্তি পুজো তো করা হয়েই। পাশাপাশি আরও নানান ভাবে লক্ষ্মীকে কল্পনা করে তাঁর পুজো করা হয়। যেমন- 

·         আড়ি লক্ষ্মী। এ ক্ষেত্রে ধান ভর্তি ঝুড়ির ওপর কাঠের লম্বা দুটি সিঁদূর কৌটো লাল চেলিতে মুড়ে লক্ষ্মীর রূপ দেওয়া হয়।

·         আবার কলার পেটোর তৈরি নৌকা লক্ষ্মী আরাধনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এগুলিকে সপ্ততরী বলা হয়। বাণিজ্যিক নৌকার প্রতীক এই সপ্ততরী। অনেকেই পুজোর সময় এই সপ্ততরীতে টাকা, শস্য, হরিতকি, কড়ি, হলুদ রাখেন।

অন্য দিকে প্রকারভেদে সরায় পটচিত্রের সাহায্যেও লক্ষ্মীপুজো হয়। যেমন- ঢাকাই সরা, ফরিদপুরি সরা, সুরেশ্বরী সরা ও শান্তিপুরি সরা। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় লক্ষ্মীরা আঁকা হয়। 

১. অঞ্চল ভেদে এই সরায় তিন, পাঁচ, সাতটি পুতুল আঁকা হয়। এতে থাকে লক্ষ্মী, জয়া ও বিজয়া-সহ লক্ষ্মী, রাধাকৃষ্ণ, সপরিবার দুর্গা ইত্যাদি। 

২. সুরেশ্বরী সরায় মহিষাসুরমর্দিনী আঁকা থাকেন আর এই সরার নীচের দিকে থাকেন সবাহন লক্ষ্মী। 

আবার কলার বের ও লক্ষ্মীর মুখ সমন্বিত পোড়া মাটির ঘটকেও লক্ষ্মী রূপে কল্পনা করে পুজো করা হয়। এই ঘটে চাল বা জল ভরে সেটিকে লক্ষ্মী মনে করে পুজো করা হয়।


তারাপীঠে তারা মায়ের আবির্ভাব তিথি উপলক্ষে চলছে বিশেষ পুজো। আশ্বিন মাসের শুক্লা চতুর্দশীর এই তিথিতে প্রতিবছর মন্দির চত্বরে তিল ধারনের জায়গা থাকে না। করোনা আবহের মধ্যেও মন্দির চত্বরে উপচে পড়ছে ভক্তদের ভিড়। পুজোর প্রস্তুতি চলছে জোড়কদমে।

একমাত্র আজকের দিনেই মা তারাকে মূল গর্ভগৃহ থেকে বের করে এনে বিশ্রাম কক্ষে রাখা হয়। সন্ধের পর আবাবও তাঁকে গর্ভগৃহে নিয়ে গিয়ে রাখা হয়। আবির্ভাব দিবসে মাতারা উপবাসী থাকেন। এদিন দুপুরে মাকে কোনও অন্নভোগই দেওয়া হয় না। রাতে স্নান ও সন্ধ্যারতি হওয়ার পর প্রসাদ হিসাবে শুধুমাত্র দেওয়া হয় ফল। পরে বিশ্রাম কক্ষ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর ভোগ দেওয়া হয়।

কথিত আছে, তারাপীঠের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া দ্বারকা নদ ধরে বাণিজ্য করতে যাচ্ছিলেন বণিক জয় দত্ত। সেই সময় সাপের কামড়ে তাঁর পুত্রের মৃত্যু হয়। বণিক শোকবিহ্বল হয়ে পড়েন। অন্যদিকে সে সময় বণিকের ভৃত্যরা রান্না করার জন্য কাটা শোল মাছ, নদ সংলগ্ন পুকুরে, ধোয়ার জন্য নিয়ে যায়। পুকুরের জলে কাটা মাছগুলি বেঁচে ওঠে, বলেই কিংবদন্তি। অলৌকিক সেই ঘটনার কথা বণিক জানতে পেরে মৃত ছেলেকে সেই পুকুরের জলে স্নান করান। মৃত পুত্র ‘‌জয় তারা জয় তারা’‌ বলে ফের বেঁচে ওঠেন। সেই রাতে মা তারার মন্দির প্রতিষ্ঠার স্বপ্নাদেশ পান জয় দত্ত। দিনটি ছিল শুক্লা চতুর্দশী। সেই দিনেই প্রথম তারাপীঠে বণিক মা তারাকে প্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু করেন। তারপর থেকে এই দিনটি মাতারার আবির্ভাব দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।

Journalist Name : Priyasree Konar

Related News