বাঙালীর লোকবিশ্বাসে ভূত চতুর্দশীর ভূমিকা

banner

#Kolkata:

হুজুগে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ দুর্গাপূজার রেশ কাটতে না কাটতেই তাই তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় কালী পুজোর।

কিন্তু কালী পুজোর আগের দিন বাঙালি পালন করে ভূতচতুর্দশী। মনে করা হয় এই দিন অশরীরী, অতৃপ্ত আত্মারা পৃথিবীর বুকে নেমে আসে। মহালয়ায় যেমন পিতৃ পুরুষের উদ্দেশ্যে জল দান করা হয় তেমনি দীপান্বিতা কালীপুজোর আগের দিন চতুর্দশীর ক্ষণে চোদ্দ প্রদীপ জ্বালানোর রীতি। এই চোদ্দ প্রদীপ পিতৃ মাতৃ কুলের সাত পুরুষের উদ্দেশ্যে প্রজ্বলিত করা হয়। ঘর বাড়ি উঠোনে সর্বত্রই প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয় এবং মনে করা হয় পূর্বপুরুষেরা আশীর্বাদ করে যান এসময়।

পুরান মতে এই দিন হল অশুভ শক্তির বিনাশের পূর্বক্ষণ। মা কালী এসময় জাগ্রত হন। লোকগাথা অনুযায়ী বাংলার ভূতেরা এই দিন শক্তিশালী হয়ে ওঠে গৃহস্থের ক্ষতিসাধন করতে চায় কিন্তু বাড়ির চারদিকে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার কারণে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করতে পারে না এছাড়াও এই দিন প্রতিটি বাঙালি পরিবারে চোদ্দ শাক খাওয়ার নিয়ম পালিত হয়ে থাকে। এই দিন দুপুরে ভাত পাতে বিশেষ এই চৌদ্দ শাকের পদ থাকবেই। ইহাও বাঙালির এক লৌকিক রীতি। যদিও চোদ্দ শাক খাওয়ার উপকারিতা আছে মানবদেহে।

এছাড়াও ভূত চতুর্দশী উপলক্ষে আরেকটি প্রচলিত গল্প রয়েছে। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী বলা হয় এক দানবীর রাজা ছিলেন দানবরাজ বলি। তার কাছে কেউ কিছু চাইলে খালি হাতে ফেরত যেত না। এই নিয়ে তিনি অহংকারী হয়ে উঠেছিলেন। পরে একসময় তিনি স্বর্গ মর্ত পাতাল এর অধীশ্বর হয়ে যান এবং দেবতাদের পরাজিত করেন। ভীত সন্ত্রস্ত্র দেবতারা ব্রহ্মার কাছে সাহায্য চাইলে তিনি বামন রূপে বিষ্ণু কে দানবরাজ বলির কাছে পাঠান। বলি কথা জানলেও তিনি বিষ্ণুকে জানতে দেননি তিনি তার পরিচয় জানেন। বামন রুপী বিষ্ণু রাজাবলির কাছে তিন পা রাখার মত জায়গা ভিক্ষা চান। বলি তার কথা রাখার জন্য বিষ্ণুর আসল পরিচয় জানার পরেও তাকে তিন পা রাখার জায়গা ভিক্ষা দেন। ভগবান বিষ্ণু তখন তার এক পা পৃথিবীতে , এক পা স্বর্গে এবং নাভি থেকে সৃষ্ট হওয়া আরেক পা রাখেন বলির মাথায় এবং পায়ের চাপে বলি ধীরে ধীরে পাতালে ঢুকে যেতে থাকে।

দানবরাজ বলি সব জেনেও বিষ্ণুকে কেবল কথা রাখার জন্য ভিক্ষা দান করেছিলেন বলে বিষ্ণু নরকাসুর রূপে মর্তে দানবরাজ বলির পূজার প্রবর্তন করেন।

কথিত আছে ভূত চতুর্দশীর দিন নরকাসূর রুপী দানবরাজ বলি পাতাল থেকে মর্তলোকে আসেন একদিনের পূজা পাওয়ার জন্য এবং তার সাথে আসে পরলোকের অসংখ্য ভুত-প্রেত তার অনুচর হিসেবে। এই চোদ্দ প্রদীপের আলো সে অসংখ্য ভূত-প্রেতদের দূরে রাখতে সাহায্য করে।

পিতৃ পুরুষদের উদ্দেশ্যে জানানো পারলৌকিক ক্রিয়ার আশীর্বাদ আসে প্রদীপ জ্বালানোকারীর উপর।

ভূত চতুর্দশীর এই তিথিতে ভালো কাজের জন্য প্রদীপ জ্বালানোর রীতি থাকলেও কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেন আমাদের মা ঠাকুরমারা। দীপান্বিতা কালীপুজোর আগের এই ভূত চতুর্দশী অমাবস্যা তান্ত্রিক বা সাধকদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক তিথি। গ্রামাঞ্চলে এখনো ঠাকুমা দিদিমারা এই দিন সন্ধ্যার পর মেয়েদের বাইরে বেরোতে নিষেধ করেন। চুল খোলা রাখতে বারণ করে থাকেন অনেকে। গল্প আছে তান্ত্রিকরা এই দিন ছোট শিশুদের ধরে নিয়ে গিয়ে সাধনার কাজে লাগান। আইনত সমস্ত বিষয় এখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ এর পর্যায় পড়লেও বহুকাল আগে এসমস্ত কেবলমাত্র গল্প ছিল না। ভুত-প্রেত নিয়ে মানুষের বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব বহুদিনের। কিন্তু কিছু রীতিনীতি বা বিশ্বাস দ্বন্দ্বের পর্যায় পরেনা। তবে একথাও ঠিক ভাল কাজের ফল যেমন ভালো হয় খারাপ কাজের ফল কিন্তু বিপদ ডেকে আনে। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে যে রীতি বহুকাল ধরে চলে আসছে তা লোকসংস্কৃতি এর এক অঙ্গ।

Journalist Name : Satarupa Karmakar

Related News