চন্দ্রকোনার ঐতিহাসিক ফাঁসিডাঙ্গা

banner

#চন্দ্রকোনা:

এখনও যেন দেওয়ালে দেওয়ালে লেগে আছে সংগ্রামের জেদ, এখনো কান  পাতলে শোনা যায় বিদ্রোহীদের চিৎকারের আওয়াজ। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম রাজনৈতিক বন্দিনী মেদিনীপুরের রাণী শিরোমণি ছিলেন দ্বিতীয় চুয়াড় বিদ্রোহের (১৭৯৮-'৯৯) নেত্রী। কর্ণগড়ের প্রাসাদ থেকে গোপন সুড়ঙ্গপথে মেদিনীপুরের আবাসগড়ে পালাতে গিয়ে ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ে যান তিনি। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল রাণী বন্দিনী হলেন ইংরেজদের হাতে! "চুয়াড় বিদ্রোহ" (মূলত, আদিম উপজাতিদের 'কৃষক বিদ্রোহ', ইংরেজরা ঘৃণাভরে নাম দিয়েছিল 'চুয়াড় বিদ্রোহ') এরপরও শেষ হয়নি, নতুন নতুন নামে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া সহ সমগ্র রাঢ়বঙ্গ ও ছোটনাগপুর অধ্যুষিত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিল। মেদিনীপুরের গড়বেতা, চন্দ্রকোনা, ক্ষীরপাই, কেশপুর, শালবনী, শিলদা, লালগড়, রামগড় প্রভৃতি এলাকায় "বাগড়ী নায়েক বিদ্রোহ" বা "পাইক বিদ্রোহ" রূপে এই আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। নেতৃত্বে ছিলেন গড়বেতার বাগড়ী রাজ বংশের রাজা ছত্র সিংহের বিশ্বস্ত পাইক সর্দার অচল সিংহ। তাঁর নেতৃত্বেই ১৮০৬-১৮১৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদিম জনজাতি সম্প্রদায়ের (লোধা, সাঁওতাল, কোল, মুণ্ডা, ভূমিজ, বাগদী প্রভৃতি) পাইক ও নায়েকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সেই সময় পাইক ও নায়েক-দের কাছ থেকে জমির অধিকার কেড়ে নেওয়া শুরু হয় এবং তাঁদের দিয়ে চাষিদেরকে নীল চাষ করাতে বাধ্য করা হয়। অন্যদিকে, পাইকদের হাত থেকে নগর রক্ষার দায়িত্বও কেড়ে নিয়ে তা দেওয়া হলো দারোগাদের হাতে। গর্জে উঠলেন পাইক-নায়েকরা।

এদিকে জমিদারদের হাত থেকেও সমস্ত ক্ষমতা ধীরে ধীরে কোম্পানির হাতে চলে যেতে লাগলো। এই পরিস্থিতিতে জমিদারদের সমর্থনে পাইক ও নায়েকদের আন্দোলন আরো তীব্র আকার ধারণ করে। হাজার হাজার চাষি, সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন ইংরেজরাও অত্যাচারের সীমা বাড়ালো। রাতের অন্ধকারে আন্দোলনকারীদের মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো ল্যাম্প পোস্টে বা গাছের ডালে। তাতেও যখন আন্দোলন দমানো যায়নি বরং তা গড়বেতা-চন্দ্রকোনা  এলাকায় তীব্র আকার ধারণ করছে, সেই সময়ই ১৮১৫ সালে চার্লস রিচার্ড ও মিস্টার হেনরি নামে ২ জন অত্যাচারী ইংরেজ সৈন্যাধ্যক্ষকে পাঠানো হল এই এলাকায়। তারাই চন্দ্রকোনার বসনছড়া এলাকার একটি ফাঁকা মাঠে তাঁবু খাটিয়ে বিচারালয় স্থাপন করে এবং একটি বটগাছের নীচে তৈরি করা হয় ফাঁসির মঞ্চ।  বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী জানা যায়, ১৮১৫-১৬ সালে এই মঞ্চেই গড়বেতা ও চন্দ্রকোনা এলাকার "নায়েক বিদ্রোহ" এর নেতা যুগল, কিশোর, সুবল, রাজেন, হাবল, ফাগু প্রমুখ ১৪ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়! দুর্ভাগ্যজনক ভাবে  সেই সময় ওই এলাকায় দারোগা ছিল নিত্যানন্দ নামে এক ভারতীয়। অপরদিকে, কুখ্যাত ও ঐতিহাসিক সেই স্থানটিই পরবর্তীকালে ফাঁসিডাঙা নামে পরিচিত হয়েছে। কথিত যে, এই অঞ্চলের আন্দোলনের প্রধান নেতা অচল সিংহ'কে ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা গুলি করে হত্যা করে। বিপ্লবের ধাত্রীভূমি মেদিনীপুরে এভাবেই চুয়াড় বিদ্রোহ, নায়েক বিদ্রোহ, পাইক বিদ্রোহ সহ বিভিন্ন উপজাতি ও কৃষক বিদ্রোহ-গুলির টুঁটি চেপে হত্যা করে অত্যাচারী ইংরেজ শাসকরা। সেই নির্মম ইতিহাসও যাতে জনসমক্ষে পরিস্ফুট হয়, নবীন প্রজন্ম যাতে জানতে পারে আদিম জনজাতিদের আন্দোলনের কাহিনী।


পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা টাউনের উত্তরে ফাঁকা মাঠের মাঝে একটু উঁচু ঢিবির ওপর ঔপনিবেশিক সময়ের সাক্ষীবহনকারী এক অখ্যাত ফাঁসির মঞ্চ! সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকারের এক শাসনযন্ত্র! একটু তত্ত্বতালাশ করলে জানা যায় এটি নীলবিদ্রোহের (1859-60) সমসাময়িক। আবার মতান্তরে চুয়াড় বিদ্রোহ (1771-1809) দমনের উদ্দেশ্য সৃষ্ট।সেজন্যই "ফাঁসিডাঙ্গা" কে গড়ে তোলা হচ্ছে পর্যটনস্থল রূপে। প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, খুব শীঘ্রই তা ভ্রমনার্থী বা পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হবে।

ইতিহাসের পাতায় মেদিনীপুরের অর্থাৎ বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনা এলাকার এই ফাঁসিডাঙা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ না থাকলেও, এলাকার নানা প্রামাণ্য নথি এবং সমাজ গবেষক ও স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিত্বদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে এই এলাকাতেই চুয়াড় বিদ্রোহ পরবর্তী নায়েক বিদ্রোহ বা পাইক বিদ্রোহের আন্দোলন কারীদের ফাঁসি কাঠে ঝোলানো হয়েছিল। সংরক্ষণের অভাবে ঐতিহাসিক সেই ফাঁসিডাঙার মাঠ ঝোপজঙ্গলে পূর্ণ হয়েছিলো এবং ফাঁসির মঞ্চ ধীরে ধীরে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছিল। অবশেষে বিংশ শতাব্দীর নয়ের দশকে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ওই ফাঁসিডাঙা মাঠ ও ফাঁসির মঞ্চ সংস্কার সাধনের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু, বিভিন্ন কারণে সেই কাজ সম্পূর্ণ হয়না, বরং তা পুনরায় অবহেলা ও অযত্নের অন্ধকারে ঢেকে যায়! আর, সেই সুযোগেই ওই স্থান হয়ে ওঠে সমাজবিরোধীদের আসর জমানোর অন্যতম জায়গা। এমনটাই জানালেন এলাকার প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী তারাপদ বিষই। তিনি এও জানিয়েছেন, "বর্তমান সরকারের আমলে প্রথম দিকে কোনও উদ্যোগ না নেওয়া হলেও, অবশেষে তা ব্লক প্রশাসন ও বসনছড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের উদ্যোগে এক আকর্ষণীয় পর্যটনস্থল এবং ঐতিহাসিক স্থান রূপে গড়ে তোলা হচ্ছে। এখানে রাত্রিবাসের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।" এজন্য প্রায় ১ কোটি টাকা সরকারিভাবে অনুমোদিত হয়েছে বলেও জানা গেছে। এলাকার প্রবীণ চিকিৎসক ডাঃ সুদর্শন রায় জানিয়েছেন, "ফাঁসিডাঙা ইংরেজ অত্যাচারের জ্বলন্ত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে! নায়েক আন্দোলন দমন করতে, বিদ্রোহীদের এখানে ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো নির্মম, নিষ্ঠুর ভাবে। সেই অত্যাচারের ইতিহাস এবং বিদ্রোহের ইতিহাস এই প্রজন্মেরও জানা উচিত। প্রশাসনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।"


পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার চন্দ্রকোনা টাউন থানার অন্তর্গত ৩ নং বসনছড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত এই 'ফাঁসিডাঙা'র ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল অবিভক্ত মেদিনীপুরের ইতিহাস ও সমাজ গবেষক অরিন্দম ভৌমিক-ও। তিনি বললেন, "স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা লগ্নে আদিম জনজাতি ও গ্রাম বাংলার কৃষকদের আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান মেদিনীপুরের এই গড়বেতা, চন্দ্রকোনা, কর্ণগড় সহ বিস্তীর্ণ এলাকা। তাই, চন্দ্রকোনার এই ফাঁসিডাঙাকে ঐতিহাসিক পর্যটনস্থল রূপে গড়ে তোলার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।ঘাটাল মহকুমার ভূমিপুত্র তথা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক কর্মাধ্যক্ষ শ্যামপদ পাত্র জানিয়েছেন, ঘাটাল মহকুমার অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান ফাঁসিডাঙা। অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকের নির্মমতার অনেক কাহিনী আমরা শুনেছি, অনেক কিছুই আবার অজানা। তাই, ইতিহাসকে জানা প্রয়োজন। সেজন্যই আমাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে সমস্ত ঐতিহাসিক স্থান সংস্কার সাধন এবং জনসাধারণের জন্য পর্যটনস্থল রূপে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে স্থানীয় মানুষ কিছুটা হলেও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে।

Journalist Name : SANGITA RANA

Related News