Flash news
    No Flash News Today..!!
Monday, May 6, 2024

দিয়োগো মারাদোনাঃ বিশ্ব ফুটবলের এক অমর সৃষ্টি

banner

#Pravati Sangbad Digital Desk:

(চতুর্থ পর্ব)
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল আর্জেন্তিনা মুখোমুখি ৮২-র বিশ্বকাপের রানার্স দল পশ্চিম জার্মানির। খেলা শুরু হওয়ার ২৩ মিনিটের মাথায় হোসে লুইস ব্রাউন দুর্দান্ত একটি গোলে আর্জেন্তিনাকে ১-০ গোলে এগিয়ে দিলো। প্রথমার্ধের খেলা এই স্কোরলাইনেই শেষ হল। বিরতির পর, ৫৬ মিনিটের মাথায় অতর্কিতে আর্জেন্তিনার  ভ্যালদানো দলকে ২-০ গোলে এগিয়ে দিলো। গতবারের মতো দ্বিতীয়বার কাপের এতকাছে এসে সপ্নভঙ্গ হয়ে যাবে এইটা মেনে নিতে পারলো না পশ্চিম জার্মানির ফুটবলাররা। তেড়েফুঁড়ে খেলা শুরু করলো রুমিনিগে, লোথার ম্যাথিউসরা। তার ফলও পাওয়া গেলো হাতেনাতে। ৭৪ মিনিটে প্রথমে রুমিনিগে, তারপর ৮১ মিনিটে ফোলার পর পর দুটি গোল করে স্কোরলাইন ২-২ করে দিলো। খেলার ৮৪ মিনিটে হঠাৎ ফুটবলের ভগবানের পায়ে অরক্ষিত অবস্থায় বল চলে গেলো। সারা ম্যাচ জুড়ে যাকে পশ্চিম জার্মানির খেলোয়াড়রা মার্কিং করে রেখেছিলো সেই দেবদূতের কাছে এসে গেলো সুবর্ন সুযোগ, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছুটা ড্রিবিলিং করে ম্যাথিউসকে বোকা বানিয়ে  বল এগিয়ে দিলেন হর্হে বুরচাগার পায়ে। বুরচাগা কোনো ভুল না করে বল ঠেলে দিলেন গোলের দিকে। আর্জেন্তিনা এগিয়ে গেলো ৩-২ গোলে। খেলার শেষ বাঁশি বাজার আগে পর্যন্ত পশ্চিম জার্মানির খেলোয়াড়রা আর সেই গোল শোধ দিতে পারেনি। অতএব পরপর দুইবার পশ্চিম জার্মানির স্বপ্নভঙ্গের মুহূর্তেপৃথিবী দেখল ফুটবলের এক নতুন দেবতাকে। সেই দেবতা আর কেউ নন প্রয়াত কিংবদন্তী দিয়োগো মারাদোনা। যার ফুটবল শৈলী মানুষে আজও ইউটিউবে দেখেন।
বুয়েনোস আইরেসে জন্মগ্রহণকারী দিয়োগো মারাদোনা ছিলেন পরিবারের সবথেকে বড় ছেলে। মারাদোনার দুই ভাই এবং এক বোন ছিল। দুই ভাইও পেশাদার ফুটবলের সাথে দীর্ঘকাল জড়িত ছিল।মাত্র আট বছর বয়সে, মারাদোনাকে একজন প্রতিভাবান স্কাউট তার প্রতিবেশী ক্লাব এস্ত্রেয়া রোহাতে খেলতে দেখে। অতঃপর তিনি উক্ত স্কাউটের বদৌলতে বুয়েনোস আইরেস ভিত্তিক ফুটবল ক্লাব আর্জেন্তিনোস জুনিয়র্সের প্রথম ডিভিশনের দল লস সেবায়িতাস-এ যোগদান করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তাঁর  তায়েরাস দে কর্দোবা দলের বিপক্ষে আর্জেন্তিনার প্রিমিয়াম বিভাগে সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে অভিষেক হয়। অভিষেক ম্যাচেই  মারাদোনা হুয়ান দোমিঙ্গো কাব্রেরার পায়ের মধ্য দিয়ে এমন একটি নাটমেগ করে বল নিয়ে যান যা পরবর্তিকালে ঐতিহাসিক আখ্যা পায়। তাঁর কিছুদিন পরেই মারপ্লাতেন্সের বিপক্ষে মারাদোনা ক্লাব ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চো পর্যায়ে প্রথম গোলটি করেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত মারাদোনা লস সেবায়িতাসে খেলেন এবং এই সময়ে প্রতি বছরেই তিনি প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চো গোলদাতার খেতাব অর্জন করেন। এরপর ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে মারাদোনা তাঁর স্বপ্নের ক্লাব 'বোকা জুনিয়র্সে' যোগ দেন। কিন্তু প্রাথমিকভাবে দলের ম্যানেজার সিলবিও মারজেলিনির সাথে বিবাদ বাদে। উপরন্ত এই দলটির ওপর সেখানকার কুখ্যাত মাফিয়ার একটি যোগাযোগ ছিল। 'বোকা জুনিয়র্সে' তাই মারাদোনা একটি মাত্র মরশুম অতিবাহিত করেন এবং সেই মরশুমে দলকে লিগ শিরোপাও এনে দেন। ১৯৮২ সালে ৭.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে মারাদোনা বার্সেলোনাতে যোগ দেন। ১৯৮২-১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মারাদোনা বার্সেলোনাতে ছিলেন। সেই সময়ের মধ্যেকোপা দেল রে এবং স্প্যানিশ সুপার কাপ জয়ের সাথে সাথে, এল ক্লাসিকোতে নিজের বুদ্ধিদীপ্ত এবং অসাধারণ ফুটবল নৈপুন্যে ভর করে রিয়াল মাদ্রিদকে পরাজিত করেন। এই সময়ে মারাদোনা প্রথমে হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হন। সুস্থ হয়ে মাঠে ফেরার কিছু দিনের মধ্যে অ্যাটলেটিকো বিলবাও-এর সাথে একটি ম্যাচে বিপক্ষের করা কড়া ট্যাকেলে মারাদোনার গোড়ালি ভেঙ্গে যায়। যার ফলে তিন মাসের জন্য তিনি মাঠের বাইরে চলে যান। এরপর ১৯৮৪ সালের কোপা দেল রে'র ফাইনাল ম্যাচে বার্সেলোনা ১-০ গোলে অ্যাটলেটিকো বিলবাও কে পরাজিত করে। এরপরে ম্যাচ শেষে বিপক্ষ খেলোয়াড়ের উস্কানি মুলক মন্তব্যের জেরে মারাদোনা বাকবিতণ্ডায় জরিয়ে যান এবং যা মারপিটে রূপান্তরিত হয়। মারাদোনা প্রথমে একজন বিপক্ষ খেলোয়াড়কে কনুই দিয়ে আঘাত করেন। তারপর অপর এক খেলোয়াড়কে মাথায় আঘাত করেন, এরপরও দমে না গিয়ে আরও এক খেলোয়াড়কে  হাঁটু দিয়ে আঘাত করে অজ্ঞান করে দেন। এর ফলে মাঠে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এর কিছুদিন পরে হুয়ান কার্লোস স্টেডিয়ামে দর্শকের মারাদোনার প্রতি চূড়ান্ত অভব্যতার জন্য তাঁর বার্সেলোনা ক্লাবের ক্যা রিয়ারে ইতি পরে যায়। ১৯৮৪ সালে তখনকার রেকর্ড অর্থে মারাদোনা বার্সেলোনা থেকে ইতালির ক্লাব নাপোলিতে যোগদান করেন।

১৯৮৪ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত মারাদোনা নাপোলিতে নিজের ফুটবল ক্যারিয়ার অতিবাহিত করেন। এই সময়ে নাপোলি একটি করে কোপ্পা ইতালিয়া, সুপার কাপ এবং সুপার কোপ্পা ইতালিয়ানা -র শিরোপা ঘরে তোলে। এই সময়ে নাপোলির হয়ে ১১৫টি গোল করে তিনি সর্বকালের সেরা গোলদাতায় পরিণত হন। তবে উক্ত সময়ে মারাদোনা কোকেনের ব্যাবহার সহ অবৈধ পুত্র এবং বিভিন্ন অসামাজিক ক্রিয়াকলাপে জরিয়ে পরেন। যার ফলস্বরূপ ফিফা মারাদোনার ওপর ১৫ মাসের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নিষেধাজ্ঞা শেষ হতেই বহু বিধিনিষেধ পেরিয়ে মারাদোনা সেভিয়াতে পাড়ি জমান। সেখানে পুরনো হাঁটুর ব্যাথায় ভুগতে থাকেন। ফলস্বরূপ লিগের বেশিরভাগ ম্যাচে তিনি অনুপস্থিত থাকেন। এবং সেভিয়ার হয়ে খেলা মারাদোনার শেষ ম্যাচে হাঁটুতে ব্যাথার জন্য ৫৩ মিনিট পরে তিনি বসে যান। সেই মরশুমে সেভিয়া লিগে সপ্তম স্থান অর্জন করেন। এরপর মারাদোনা ১৯৯৩ সালে আরজেন্তেনিয় ক্লাব নিওয়েল'স ওল্ড বয়েসে যোগ দেন। সেখানে তিনি কয়েক মাস কাটিয়ে কোচের সঙ্গে মতের অমিল এবং পেশীতে চোট থাকায় ওই দল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। এর ঠিক ৩ বছর পরে ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে ফের 'বোকা জুনিয়র্সে' যোগ দেন। সেখানে ৩ মাস কাটিয়ে অক্টোবর মাসে মারাদোনা ৩৭ বছর বয়সে অবসর ঘোষণা করেন। বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে তিনি সর্বমোট ৪৯১টি ম্যাচ খেলে ২৫৯টি গোল করেন। আন্তর্জাতিক মঞ্চে তিনি আর্জেন্তিনার জার্সি গায়ে ৪টি বিশ্বকাপ খেলেছেন যার মধ্যে ১৯৮৬ এর বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন এবং ১৯৯০ এর বিশ্বকাপে আর্জেন্তিনা রানার্স হয়। ১৯৮২ এর বিশ্বকাপ মারাদোনার প্রথম বিশ্বকাপ ছিল। এই বিশ্বকাপের দ্বিতীয় ম্যাচে মারাদোনার জোড়া গোলে আর্জেন্তিনা হাঙ্গেরিকে হারায়। এরপর দ্বিতীয় রাউন্ডে ইতালি এবং ব্রাজিলের কাছে হেরে আর্জেন্টিনা ওই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়। প্রতি ম্যাচেই মারাদোনাকে লক্ষণীয়ভাবে ফাউল করা হয়। দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিল ম্যাচে ৩-০ গোলে পিছিয়ে থাকায় মারাদোনার মনখারাপ হয়ে যায় এবং ব্রাজিলের বাতিস্তাকে বিশ্রীভাবে ফাউল করে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন। এরপর ১৯৮৬ বিশ্বকাপ মারাদোনার জন্য সবাই মনে রেখেছে। এই বিশ্বকাপে মারাদোনা ৫টি ম্যাচে ৫ গোলের সাথে ৫টি অ্যাসিস্ট করেন। এই বিশ্বকাপেই মারাদোনা ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার-ফাইনাল ম্যাচে প্রথমে 'হ্যান্ড অফ গড" গোলটি করেন এবং ঠিক এরপরেই ৫জন ইংরেজ প্লেয়ারকে কাটিয়ে বিশ্বমানের গোল করেন। এই খেলার পর প্রথম গোলের কুখ্যাতি এবং দ্বিতীয় গোলের মহিমা সম্পর্কে ফরাসি সংবাদপত্র লেকুইপে মারাদোনাকে "অর্ধ-দেবদূত, অর্ধ-শয়তান" হিসেবে বর্ণনা করেন। এই বিশ্বকাপে মারাদোনা বিশ্বকাপ জয়ের সাথে সাথে ফিফা বিশ্বকাপ গোল্ডেন বল, ফিফা বিশ্বকাপ সিলভার শু, ফিফা বিশ্বকাপ সর্বাধিক অ্যাসিস্ট এর খেতাব জয় করেন। ১৯৯০ এর বিশ্বকাপে মারাদোনা গোড়ালির ব্যথায় কাবু ছিলেন। তবুও ওই অবস্থাতেই দলকে নিয়ে যান ফাইনালে। ওই ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে, আর্জেন্তিনার দ্বিতীয় বারের জন্য বিশ্বকাপ হাতছাড়া হয়।তবে বিশ্বকাপের ব্রোঞ্জ বল খেতাব জয়লাভ করেন। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে মারাদোনা মাত্র দুটি ম্যাচে অংশগ্রহণ করেন। এরপর  এফিড্রিন ডোপিংয়ের জন্য মাদক পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার পর তাকে দেশে পাঠানো হয়। আর্জেন্তিনার হয়ে এটাই মারাদোনার শেষ ম্যাচ। আর্জেন্তিনার জার্সিতে ৯১টি ম্যাচ খেলে ৩৪টি গোল করেন। ৮৬র বিশ্বকাপ ছাড়া মারাদোনা ১৯৯৩ সালে আরতেমিও ফাংকি শিরোপা জয়লাভ করেন। বিশ্ব ফুটবলের ভগবান মারাদোনার বৈচিত্র্যময় ক্যরিয়ারে অনয়মিত জীবন- যাপন না করলে তিনি হয়তো আরও বেশিদিন খেলা চালিয়ে যেতে পারতেন। তাঁর এই অনয়মিত জীবনের জন্যই ২০২০ সালে  মাত্র ৬০ বছর বয়সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন।

Journalist Name : Tamoghna Mukherjee

Related News