Flash news
    No Flash News Today..!!
Tuesday, May 14, 2024

৮৬ বছরে রাজনীতির চানক্য, স্মরণে প্রনব মুখোপাধ্যায়

banner

#Pravati Sangbad Digital Desk:

সালটা ১৯৩৫, ব্রিটিশদের হাত থেকে তখনও মুক্তি পাইনি ভারত, সেই বছরের ১১ই ডিসেম্বর বীরভূম জেলার মিরাটি গ্রামের মুখোপাধ্যায় পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন প্রনব কুমার মুখোপাধ্যায়। বাবা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ব্রিটিশ পুলিশের আহতে ধরা পরে প্রায় ১০ বছর কারারুদ্ধও ছিলেন বাবা কামদাকিঙ্কর। কংগ্রেসের সাথে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের যোগ জন্মসূত্রে, কারণ তার স্বাধীনতা সংগ্রামী বাবা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ১৯২০ সাল থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে যুক্ত ছিলেন। পরে অবশ্য অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি ও বঙ্গীয় বিধান পরিষদের সদস্যও ছিলেন বহু দিন। কাজেই কংগ্রেসের কাছে প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিল তার ঘরের ছেলে।


প্রণব মুখোপাধ্যায় বীরভূম জেলার সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র ছিলেন। তবে প্রথম জীবনে প্রণব মুখোপাধ্যায় কলেজ শিক্ষক হিসেবেই কর্মজীবন শুরু করেন, অন্যদিকে যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতা পেশার সাথেও। “দেশের ডাক” নামে এক পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিদ্যানগর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। এরপর শুরু হয় সক্রিয় রাজনৈতিক পথযাত্রা। ১৯৬৯ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি, সেই বছরই রাজ্যসভায় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করা হয় তাঁকে। সেই মঞ্চেই ইন্দিরা গান্ধীর চোখে পরে যান নবাগত প্রণব। ১৯৬৯ সালের রাজ্যসভার উচ্চকক্ষে অধিবেশন চলছে, চলছে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ নিয়ে তর্ক বিতর্ক, কক্ষের পেছন সারি থেকে বলতে ওঠেন ৩৪ বছরের এক তরুণ, তার বক্তিতাই কিছুক্ষণের জন্য শান্ত হয়ে যায় অধিবেশন কক্ষ, কক্ষে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তরুনের বক্তিতাই হতবাক তিনি, মুগ্ধ হয়েছিলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবীররা। অধিবেশন শেষ হতেই প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার সেক্রেটারির কাছে তরুণ সাংসদের নাম জানতে চান, কিন্তু তরুণ প্রণব তখন সবার কাছেই অচেনা। পরে ইন্দিরা গান্ধী তার নাম জানতে পারেন। ক্ষুরধার রাজনৈতিক মস্তিস্ক আর সাধারন জ্ঞ্যানের জন কিছু দিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর আস্থা ভাজন হয়ে ওঠেন প্রনব মুখোপাধ্যায়। সেই একসাথে পথ চলা শুরু। তারপর থেকেই সেকেন্ড ম্যান, সামেলছেন একের পর এক গুরু দায়িত্ব। প্রতিরক্ষা থেকে শুরু করে অর্থমন্ত্রী শিল্প কিংবা পরিবহন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন এই বঙ্গ সন্তান। মিরাটিতে তার গ্রামের বাড়ির দুর্গা পূজাই সুদূর দিল্লি থেকে উড়ে আসতেন প্রতিবছরেই, আর সেই সাথে উড়ে আসতো ক্যাবিনেট। রাজনীতি থেকে শুরু করে বাড়ির পুজো সব কিছুই নিষ্ঠার সাথে সামাল দিয়েছেন নিজে হাতে।   দুঃসময়ে কংগ্রেসকে পথ দেখিয়েছেন তিনি, ইন্দিরা গান্ধী হোক বা তার পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী এমনকি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং জাতীয় কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব বার বার ছুটে গেছে কীর্ণাহারের এই আদ্যপ্রান্ত বাঙালি সন্তানের কাছে। নামের সাথে জুড়ে গিয়েছে ক্রাইসিস ম্যানেজার। নিজের দল সারাজীবন তাঁকে সন্মান জানিয়ে গেছে, তার সাথে বিরোধীরাও জানিয়েছেন সন্মান, কারণ ব্রাহ্মণ সন্তান প্রনব কোনদিনই কাউকে হেও করেননি। এর জন্য বারবারই কটাক্ষের শিকার হয়েছেন তিনি। ২০১১ সালে তৃণমূলের সাথে জোট বেধেছিল কংগ্রেস, দীর্ঘ ৩৪ বছরের লাল পতাকা বাংলার ক্ষমতা হারালেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাথে কোন দিনই বিরোধ ছিল না তার।


১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে দল থেকে খানিকটা পেছনে চলে গেছিলেন প্রনব মুখোপাধ্যায়। যোগ্যতা থাকা সত্বেও হতে পারেননি প্রধান মন্ত্রী। ১৯৯৭ সালের শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কার তার ঝুলিতে। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর দল থেকে বহিষ্কৃতও হয়েছিলেন তিনি, নিজের ক্যাবিনেটে স্থান দেননি রাজীব গান্ধী। পরবর্তীকালে পি ভি নরসিমা রাও তাকে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত করেন, আরও একবার জাতীয় রাজনীতিতে উত্থান ঘটে প্রনব মুখোপাধ্যায়ের। দীর্ঘ পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে সাক্ষী থেকেছেন বিভিন্ন উত্থান পতনের। রাজনৈতিক জীবনের মূল মন্ত্র ছিল সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলা। নিজের বক্তব্যে সারাজীবনই অনড় থেকেছেন কীর্ণাহারের সেই ছেলেটি, তবে কোন দিনই অন্যদের বক্তব্যকে ছোট করেননি, সবসময় শুনেছেন সবার কথা। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের শেষে বীরভূমের মেঠো পথ ধরে হাটতে হাটতে পৌঁছে গেছেন শীর্ষে, ২০১২ সালে দেশের প্রথম নাগরিক নির্বাচিত হন তিনি। এনডিএ প্রার্থী পিএন সাংমাকে ৭০ শতাংশের বেশি ভোটে হারিয়ে পৌঁছে যান রাইসেনা পাহাড়ির ভবনে। ২০১২ সালের ২৫ জুলাই আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশের ১৩তম রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন মিরাটির ব্রাহ্মণ সন্তান প্রনব মুখোপাধ্যায়। বাঙালির মাথাই অথে নতুন পালক, দেশের প্রথম নাগরিক একজন বাঙালি, ইতিহাস গড়লেন প্রনব মুখোপাধ্যায়। রাষ্ট্রপতি হয়েও কাজ ছেড়ে থাকেনি তিনি, একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়িত করেছেন ইংরেজদের তৈরি সুবিশাল ভবনটিতে। সর্বজয়ী প্রনব মুখোপাধ্যায়কে অবশেষে হার মানতে হয় মৃত্যুর কাছে। ২০২০ সালের ৯ই আগস্ট দিল্লিতে নিজের বাসভবনে পরে মাথাই চোট পান প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেধে যায়, দীর্ঘ ২২ দিন দিল্লির সেনা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে পরাজিত হন তিনি। ৩১শে আগস্ট শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। দিল্লিতে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদাই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় তার। প্রনব মুখোপাধ্যায়ের মতো বর্ণাঢ্য জীবন খুব কম বাঙালির কপালেই জোটে। মৃত্যুর পরে হয়ত তিনি আবার যোগ দিয়েছেন তার কাছের মানুষ ইন্দিরা গান্ধীর সাথে, আবার হয়তো রাজনীতির চানক্য হয়ে উঠেছেন তিনি। আজ ১১ই ডিসেম্বর তার ৮৬তম জন্মবার্ষিকীতে বাঙালি আজও মনে করছে তাদের সর্বকালের প্রিয় প্রনব বাবুকে।

Journalist Name : Sabyasachi Chatterjee

Related News