হার না মানা লড়াইয়ের আর এক নাম যুবরাজ সিং

banner

#PRAVATI SANGBAD DIGITAL DESK:

ক্রিকেট ভালোবাসেনা এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিশেষকরে ভারতীয়রা। ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ। ফুটবলের চেয়ে আমাদের দেশে বেশী জনপ্রিয় ক্রিকেট। এক একজনের এক এক রকম ভক্ত। কেউ শচীন, কেউ সৌরভ কেউ কোহলি, কেউ যুবরাজের। এমনি করে প্রতিটি ক্রিকেটারের লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ভক্ত ছড়িয়ে রয়েছে দেশ বিদেশে। ভক্তরা বিশেষ ভাবে পছন্দ করে তাদের প্রিয় খেলোয়াড়ের খেলা দেখতে। কেউ কেউ তাকে অনুস্মরণ করে, কেউ কেউ আবেগ ভালোবাসায় তার প্রিয় ক্রিকেটারের জন্মদিন পালন করে বিশেষ ভাবে। এমনই এক জনপ্রিয় ক্রিকেটার যুবরাজ সিং। নিজের দিনে তার চেয়ে ভয়ঙ্কর ও ধ্বংসাত্মক ক্রিকেটার আর কেউ ছিলনা। বোলারদের একপ্রকার খুন করত বলাই যায়।
জ্বর, কাশি, কাশির সঙ্গে রক্ত, রাতে ঘুম না আসা, হাঁপানি, এইগুলি সঙ্গী হয়ে গিয়েছিল ২০১১ বিশ্বকাপ জেতা নায়কের। দেশকে বিশ্বকাপ এনে দিয়ে যে হাজার আলো জ্বলে উঠেছিল তাঁর চারপাশে, কিছু দিনের মধ্যেই সেই সব কেমন ঝাপসা হতে শুরু করল। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির বিশ্বকাপ জেতানো ছয়ের পর তাঁর কোলে লাফিয়ে ওঠা যুবরাজ সিংহের স্থান হল হাসপাতালের বিছানায়। ক্যানসার।

“যুবরাজের কেরিয়ারটা বোধ হয় শেষ হয়ে গেল।” ভারত তখন সদ্য বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। ৩৬২ রান এবং ১৫টি উইকেট নিয়ে সেই বিশ্বকাপের সেরা ক্রিকেটার যুবরাজ। ভারতীয় ক্রিকেটের ‘গ্ল্যামার বয়’। তাঁকে নিয়েই এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে ক্রিকেট ভক্তদের মনে। ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়তে নেমেছেন যুবরাজ। আর তাঁকে ব্যাট হাতে দেখা যাবে কি না সেই নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। কিন্তু যুবরাজ কী ভাবছেন? বাঁহাতি অলরাউন্ডার বললেন, “আমি একবারই ক্যানসারকে মেনে নিয়েছিলাম, যখন বিশ্বাস করলাম একে হারাতে পারব। জীবন যখন তোমাকে মাটিতে ফেলে দিয়েছে, তখন একটাই পথ খোলা থাকে— উঠে দাঁড়ানো। তাই নিজেকে বললাম— ওঠো, আবার লড়তে হবে।”
লড়লেন, জিতলেন এবং ফিরে এলেন। ২০১২ সালের মার্চ মাসে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন যুবরাজ। ভারতের জার্সি গায়ে মাঠে নেমে পড়লেন সেই বছরের সেপ্টেম্বরে। এটাই জেদ, কলার তোলা আগ্রাসন। এটাই যুবরাজ সিংহ।
যুবরাজ সিং একজন প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার যিনি সব ধরনের ক্রিকেট খেলেছেন। তিনি একজন অলরাউন্ডার যিনি বাঁহাতি মিডিয়াম পেসে বল করতেন এবং মিডল অর্ডারে বাঁহাতি ব্যাটিং করতেন। তার পিতা পাঞ্জাবী চলচ্চিত্র তারকা যোগরাজ সিং।ভারতের হয়ে খেলতে আসা ওয়ানডে খেলোয়াড়দের মধ্যে যুবরাজ ছিলেন অন্যতম, তিনি তার ব্যাটিং আর ফিল্ডিংয়ের জন্য বিশেষভাবে খ্যাতি পেয়েছিলেন।

১৯৯৯ সালে প্রথম ব্রেক-থ্রু পেয়েছিলেন যুবরাজ। অনুর্ধ্ব ১৯ কোচবিহার ট্রফিতে বিহারের বিরুদ্ধে এক ইনিংসে ৩৫৮ রান বানিয়েছিলেন যুবি। যা প্রথম ইনিংসে তোলা বিহারের দলগত রানের থেকে এক রান বেশি।
ওই ইনিংসের সৌজন্যে সেবার শ্রীলঙ্কাগামী অনুর্ধ্ব ১৯ ভারতীয় দলে জায়গা পেয়েছিলেন যুবরাজ। সিরিজের তৃতীয় ওয়ান ডে ম্যাচে ৫৫ বলে বিধ্বংসী ৮৯ রান করেছিলেন যুবি। ১৯৯৯-২০০০ মরশুমের রনজি ট্রফিতে হরিয়ানার বিরুদ্ধে ১৪৯ রান বানিয়েছিলেন এই বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান। ২০০০ সালের অনুর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে মহম্মদ কাইফ নেতৃত্বাধীন ভারতীয় দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। বলে-ব্যাটে কামাল দেখানো যুবরাজ সেই টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপরেই ভারতের সিনিয়র দলের দরজা খুলে যায় তাঁর সামনে।
২০০০ সালে তিনি ওয়ানডে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারতের হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন এবং ২০০৩ সালের অক্টোবরে তার প্রথম টেস্ট ম্যাচে খেলেন। ২০০৭ সালের আইসিসি বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টিতে এবং ২০১১ আইসিসি ক্রিকেট ওয়ানডে বিশ্বকাপে উভয়ে তিনি ভারতের মহাকাব্য জয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশীদার ছিলেন। ২০১১ সালের আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপে তিনি ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট ছিলেন।

ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা বলে ২০১১ বিশ্বকাপেই জীবনের সেরা ফর্মে ছিলেন যুবরাজ সিং। তাঁর একটি সেঞ্চুরি, চারটি হাফ সেঞ্চুরি সহ ৩৬২ রান ও ১৫ উইকেট ভারতকে সেবার বিশ্বকাপ জেতাতে বিশেষ ভূমিকা নেয়। 
তিনি ২০০০ সাল থেকে ২০১৭ সাল অবধি ভারতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য ছিলেন। ২০০৭ সালের আইসিসি বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি স্টুয়ার্ট ব্রড এর একটি ওভারে ছয়টি ছক্কা মারেন এমন একটি কীর্তি যা পূর্বে মাত্র তিনবার ঘরোয়া ক্রিকেটে ঘটে ছিল, যদিও দুটি টেস্ট ক্রিকেট দলের মধ্যে কোনও আন্তর্জাতিক ম্যাচে কখনও হয়নি। একই ম্যাচে, তিনি আর একটি কীর্তি স্থাপন করেন টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক এবং সমস্ত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সবচেয়ে দ্রুততম ৫০ রানের রেকর্ড, তিনি মাত্র ১২ বলে ৫০ রান করেছিলেন। ২০১১ বিশ্বকাপ চলাকালীন, তিনি প্রথম খেলোয়াড় হয়েছিলেন যিনি ৫ উইকেট শিকার নেওয়ার সাথে সাথে একই বিশ্বকাপের ম্যাচে ৫০ রান করেছেন। তবে 
২০১১ সালে, ঘটে এক বড় অঘটন, যুবরাজের বাম ফুসফুসে ক্যান্সারযুক্ত টিউমার ধরা পড়ে এবং তিনি বোস্টন এবং ইন্ডিয়ানাপলিসে কেমোথেরাপির চিকিৎসা করতে চলে যান। ২০১২ সালের মার্চ মাসে কেমোথেরাপির তৃতীয় ও চূড়ান্ত চক্র শেষ করে তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং এপ্রিল মাসে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। ২০১২ বিশ্ব টি-টোয়েন্টির কিছু আগে, সেপ্টেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে তিনি তার আন্তর্জাতিক প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
কেরিয়ারে ৩০৪টি ওয়ান ডে ম্যাচে ৩৬.৫৫-গড়ে ৮৭০১ রান করেছেন যুবরাজ। ১৪টি শতরান রয়েছে তাঁর। ৪০টি টেস্ট ম্যাচে ৩৩.৯২-র গড়ে ১৯০০ রান করেছেন যুবি। টেস্টে তাঁর তিনটি শতরানও রয়েছে।
২০১২ সালে, সালে তার ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার অবদানের জন্য অর্জুন পুরস্কার লাভ করেন, ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্রীড়া পুরস্কার। পরবর্তীকালে, ২০১৪ সালে, তিনি ভারত সরকারের দ্বারা পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হন, ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার। ২০১৪ আইপিএল নিলামে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু যুবরাজকে সর্বকালের সর্বোচ্চ দামে ১৪ কোটি টাকা দিয়ে তাঁদের দলে নিয়েছিল এবং ২০১৫ সালে, দিল্লি ডেয়ারডেভিলস তাঁকে ১৬ কোটি টাকা দিয়ে তাঁদের দলে নিয়েছিল।
২০১৭ সালের জুন মাসে, তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার পর আর ভারতীয় দলে খেলার সুযোগ পাননি এবং সেটাই ছিল তার সর্বশেষ খেলা। ১০ জুন ২০১৯-তে যুবরাজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন।

তার এই ছোট্ট ক্রিকেট পরিসর ও ব্যাক্তিগত জীবনের লড়াই তার অনুরাগীরা সারা জীবন মনে রাখবে। হারতে তিনি শেখেননি। তাই ক্যান্সারের মতন কঠিন মারন রোগকেও পরাজিত করে তিনি মাঠে ফিরে এসে দেশকে বিশ্বকাপ দিয়েছিলেন। তার মাঠ ও মাঠের বাইরের লড়াইকে কুর্নিশ করে গোটা দেশ তথা বিশ্ব। তার এই লড়াই আজও সকলকে প্রেরণা যোগায়। তাই এমন এক লড়াকু মানুষের জন্মদিনে তাকে জানাই কুর্নিশ।

Journalist Name : Sampriti Gole

Related News