বাংলা গানের সুরের জাদুকর, জন্মদিনে ফিরে দেখা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার

banner

#Pravati sangbad Digital Desk:

সুরের ভুবনে বাস করতেন তিনি। আধুনিক বাংলা গানের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র তিনি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দের মত শিল্পীর গলায় যাঁর গান শোভা পেয়েছে, সেই গীতিকার বাংলা গানের স্বর্ণযুগের অদ্বিতীয় গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের জন্মদিন আজ।

তাঁর কলম দিয়ে 'যদি কাগজে লেখ নাম', 'জীবন খাতার প্রতি পাতায়' ইত্যাদি বহু কালজয়ী গান বেরিয়েছে।

পাবনার গোপালনগর গ্রামে জন্ম গৌরীপ্রসন্নের। ১৯২৫ সালের ৫ ডিসেম্বর। বাবা প্রেসিডেন্সি কলেজের খ্যাতনামা অধ্যাপক উদ্ভিদবিদ গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার। তাঁর সহপাঠীদের তালিকায় ছিলেন সি ভি রমন, ডক্টর রাধাকৃষ্ণন। প্রাচীন ভারতে উদ্ভিদবিদ্যা ও কৃষিবিদ্যা নিয়ে গবেষণার জন্য সংস্কৃত পুঁথি থেকে তথ্য সংগ্রহ করতেন। ছোটদের পত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ লিখতেন। মা সুধা মজুমদার ছিলেন স্নাতক। কবিতা ও প্রবন্ধ লেখার প্রতি ছিল তাঁর অসীম আগ্রহ। ছোট থেকেই গৌরীপ্রসন্নের হাতের কাছে দেশি-বিদেশি বই। বাড়িতে বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত ভাষার চর্চা। ছাত্র জীবনের গণ্ডি পেরোনোর আগেই ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফেললেন কালীদাসের ‘মেঘদূতম’। ইংরেজি ও বাংলা দু’টিতেই স্নাতকোত্তর হয়েছিলেন তিনি।

বিলেত থেকে কাকার এনে দেওয়া গ্রামোফোনে শোনা যাঁর কণ্ঠ-সুর তাঁকে সবচেয়ে বেশি মোহিত করেছিল, তিনি শচীন দেববর্মণ। গৌরীপ্রসন্ন তখন কলেজের ছাত্র। একটি গান লিখে সটান চলে গেলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজির ছাত্র শুনে শচীনকর্তা একটা ইংরেজি বই এনে তার থেকে একটা লাইন বার করে দেখালেন, ‘ইটস আই, ইটস আই, ইট ক্যান নট বি সিন।’ এই লাইনটা মাথায় রেখে গান লিখতে বললেন। গৌরীপ্রসন্নের লেখা পছন্দ হওয়ায় তিনি তাঁকে বললেন গানটা যেন আকাশবাণীতে দিয়ে আসেন। তিনি গাইবেন। গৌরীপ্রসন্নের কাছে এটা ছিল স্বপ্নাতীত। রেডিয়োয় তাঁর লেখা গান শচীনকর্তা গাওয়ার পরে সাহস কিছুটা বাড়ল। এ বার আবদার করলেন রেকর্ডিংয়ের জন্য। শচীনকর্তা রাজি হলেন। কিন্তু শর্ত দিলেন, গৌরীপ্রসন্নকে স্নাতক হতে হবে। স্নাতক হওয়ার পরে খবর গেল তাঁর কাছে। গৌরীপ্রসন্নকে তলব করলেন শচীন। বাড়িতে গিয়ে গৌরীপ্রসন্ন জানতে পারলেন, শচীন ছ’খানা গান রেকর্ড করবেন। ছ’খানাই তাঁকে লিখতে হবে! সদ্য কলেজ পাশ করা ছেলেটি এতটা প্রত্যাশা করেননি। সারা রাত জেগে গান লিখলেন। কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা গৌরীপ্রসন্নের। সারারাতের পরিশ্রম জলে। তাঁর অবস্থা বুঝতে পেরে শচীনকর্তা একটা সুর শুনিয়ে বললেন, এর উপরে কথা বসাতে। ভয়, দুঃখ ভুলে গৌরীপ্রসন্নের কলম দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘যেন আলেয়ারে বন্ধু ভাবিয়া হায়, সহেলী গো যে কাছে গেলে দূরে সরে যায়।’ পছন্দ হল শচীনের। কিন্তু একটা উতরে গেলেও বাকিগুলোর কী হবে। মাথায় তো সেই রাত জেগে লেখা শব্দগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে। এ দিকে হাতে সময় কম। শচীন দেববর্মণ তাঁকে বিকেলে আবার আসতে বললেন। বাড়িতে ফিরে আসার আগে একটা চালাকি করলেন গৌরীপ্রসন্ন। যে গানগুলো বাতিল হয়েছিল, তার একটি শচীনের অলক্ষ্যে তাঁর হারমোনিয়ামের ডালার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। যদি মিরাকল ঘটে! বিকেলে এসে দেখলেন সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ওই গানে সুর করছেন শচীনকর্তা। আনন্দে নিজের চালাকির কথা ভুলে গিয়ে জিজ্ঞেস করে ফেললেন, ‘‘এই গানটা তো সকালে বাতিল করেছিলেন।’’ হেসে বললেন, ‘‘তুই চলে যাওয়ার পরে তোর বৌদি (মীরা বর্মণ) এসে গানটা পড়ে বলল ভাল লেখা। তখন আবার পড়ে দেখলাম। সকালে খেয়াল করিনি।’’


পেয়ে উঠে এসে শচীনের সঙ্গে কথা বললেন। কিন্তু গৌরীপ্রসন্নকে সে ভাবে পাত্তা না দেওয়ায় শচীনদেব কিছুক্ষণ পরে গৌরীপ্রসন্নকে দেখিয়ে জয়কিষণকে বলেছিলেন, ‘‘জানতা হ্যায়, কৌন হ্যায়। ইয়ে হ্যায় কলকাত্তা কা মজরুহ্ সুলতানপুরী!’’ কথাটা শুনে গৌরীপ্রসন্নও চমকে গিয়েছিলেন। তখন তিনি প্রফেশনালি গান লেখা শুরু করলেও জয়কিষণ নক্ষত্র। রেস্তরাঁ থেকে বেরিয়ে জানতে চেয়েছিলেন এই উক্তির কারণ। শচীনকর্তা বলেছিলেন, ‘‘এরা আমাকে মূল্য দেবে আর আমার সঙ্গে তুই রয়েছিস, তোকে মূল্য দেবে না? মনে মনে জেদ করবি না-ই বা কেন, তুই ও একদিন মজরুহ্ সুলতানপুরী হবি, কি তার চেয়েও বড় হবি।’’ আজীবন শচীন দেববর্মণের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল গৌরীপ্রসন্নের। ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’, ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে,’ ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’... গৌরীপ্রসন্নের কথায় ও শচীন দেববর্মণের সুরে সৃষ্টি হয়েছিল এমন অসংখ্য কিংবদন্তি গান!

সত্যি কি তিনি মজরুহ্ সুলতানপুরী হতে পেরেছিলেন? প্রশ্ন শুনে পাল্টা প্রশ্ন করলেন সুরকার নচিকেতা ঘোষের পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষ, ‘‘সেই সময়ে ভারতের এমন এক জন বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীর নাম বলতে পারবেন, যিনি গৌরীপ্রসন্নের গান গাননি?’’ উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন, ‘‘শচীন দেববর্মণ, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিশোরকুমার, রাহুল দেববর্মণ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়... নাম বলে শেষ করতে পারব না। এঁদের পাঁচটা সেরা গানের মধ্যে একটা গান গৌরীকাকার হবেই। আর বাবারও প্রায় ৭০ শতাংশ গানই তো গৌরীকাকার লেখা।’’

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি ছবি 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি'র 'আমি যামিনী তুমি শশী হে' তাঁরই লেখা। এমনকী বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ১৯৭২-এর ডিসেম্বরে বাংলাদেশ যান গৌরীপ্রসন্ন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একটি গান লিখেছিলেন। যা সেই সময় আকাশবাণীতে 'সংবাদ পরিক্রমা' অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাঝে মাঝে বাজানো হয়েছিল। গানটিতে সুর দিয়েছেন এবং গেয়েছেন অংশুমান রায়। এমনকি ওই গানের ইংরেজি অনুবাদও বের হয়। গানটির নাম 'শোনো একটি মুজিবুরের থেকে'। ১৯৮৬ সালের ২০ অগাস্ট মাত্র ৬২ বছর বয়সে দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে যান গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। তাঁর মৃত্যুতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, 'গৌরীদা ক্যানসারে মারা যান। তাঁর মত এত বড় একজন গীতিকার বম্বের অতি সাধারণ এক হাসপাতালে প্রায় মাটিতে শুয়েই শেষের দিন গুনেছেন'। তাঁর মতো প্রতিভাবান ব্যক্তি খুব কমই ছিল। বাঙালি জাতিতে এইরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে বাংলা চলচ্চিত্র জগত্‍ ও আধুনিক গানের দুনিয়া মাতিয়ে রেখেছিলেন তিনি।

Journalist Name : Sampriti Gole

Related News