জুরাসিক পার্কের সেই দৃশ্য মনে পড়ছে? বিশাল বিশাল ডিমে ফাটল ধরছে, একে একে বাড়ছে ফাটলের সংখ্যা। একসময় বেড়িয়ে এল একটি বড় বড় চোখ ওয়ালা জন্তুর মাথা। এই মাথা বেড়িয়ে আসার মুহূর্তটাকে পজ করে দিন ভিডিও। মাথাটা তখনও বেরোয়নি ডিম থেকে শুধু ফেটে যাওয়া ডিমের খোলসের নীচে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, জন্তুর ছোট্ট শরীরের কচি হাড়ের আভাস। ঠিক এই অবস্থাতেই একটি ডাইনোসরের ডিম উদ্ধার হয়েছে চিনে।
বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্য়ালয়ের জীবাশ্মবিদদের বড় সফল্য। দক্ষিণ চিনের Ganzhou থেকে উদ্ধার ডায়নোসরের একটি আস্ত ডিমের জীবাশ্ম। যার ভিতর সংরক্ষিত রয়েছে একটি ডায়নোসরের ভ্রুণ ।
উদ্ধার হওয়া ডায়নোসরের ডিমের জীবাশ্মটির একটি নামও দিয়েছেন গবেষকরা। এটিকে ‘Baby Yingliang’ নাম দেওয়া হয়েছে। জানা গিয়েছে, ডিমটি ৭ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ৮ সেন্টিমিটার চওড়া। জিনজিয়াং প্রদেশের গ্যাংজহাউ শহরের শাহে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের মাটির গভীর থেকে জীবাশ্মটি উদ্ধার হয়েছে। গবেষকদের অনুমান ডিমটি দাঁতবিহীন ওভিরাপ্টোরোসরাসের । বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্য়ালয়ের গবেষক ডাক্তার ফিয়ন ওয়াউসুম জানিয়েছেন, এটাই এখনও পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে স্পষ্ট ডাইনোসরের ডিম।
একটা মিউজিয়াম তৈরির জন্য ফসিল বাছছিলেন চিনের ইংলিং সংস্থার এক কর্মচারী। পাথর খাদানে পাথর তোলার ব্যবসা ওই সংস্থার। পাথর কাটতে গিয়েই বিভিন্ন সময়ে পাওয়া গিয়েছিল এই জীবাশ্মগুলি। হঠাৎ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল একটি বড় ডিম। অস্ট্রিচের থেকেও বড় খানিকটা। একটু লম্বাটে, ঠিক যেন ওষুধের পিল। অযত্নে পড়ে থাকায় গায়ে জমেছে ধুলো। সেই ধুলো ঝাড়তে গিয়ে চোখে পড়ল ডিমের গায়ে ফাটল, আর তা থেকে বেড়িয়ে এসেছে কোনও জন্তুর হাড়ের কিছু অংশ। তিনি তখনও জানেন না এক ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
তবে ডিমটি নিয়ে সাথে সাথেই গেলেন সংস্থার দপ্তরে, সেখান থেকে সরাসরি চিন ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ লিডা জিং-এর কাছে। ডিমটির সিটি স্ক্যান আর দরকারি সমস্ত পরীক্ষা করে জানা গেল, ওই ডিমের খোলসের আড়ালে রয়েছে আস্ত একটা ডাইনোসরের ভ্রূণ, যা পরিপূর্ণ অবস্থায় ফুটে বেরোনোর অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে পৃথিবীর আলো দেখা হয়নি সেই সাত কোটি বছর আগেকার ডাইনোসর শাবকের। তার আগেই মৃত্যু হয় তার। কালের নিয়মে যা জীবাশ্ম হয়ে এখন হতবাক করে দিয়েছে তামাম দুনিয়াকে।
আপনার মনে হতে পারে গত বছর শীতেই তো কলকাতা মিউজিয়ামের দু’তলার ঘরটায় গিয়ে দেখে এলাম ডাইনোসরের ডিম। এই নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে? এটা ঠিকই যে এর আগে জীবাশ্ম অবস্থায় বহু ডাইনোসরের ডিম আবিষ্কার হয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। কিন্তু ভ্রূণ সমেত ডাইনোসরের ডিম বিরল। কিন্তু এই আবিষ্কার নিয়ে মাতামাতির আসল কারণটা ডিম নয় তার ভিতরে থাকা ভ্রূণের অবস্থা। এত পরিণত ডাইনোসরের ভ্রূণ এখনও অবধি পাওয়া যায়নি এই সংক্রান্ত গবেষণার ইতিহাসে। আগে পাওয়া ডাইনোসরের ডিমের আশপাশ থেকে অনেক ডাইনোসরের হাড় পাওয়া গেলেও ডিমের ভিতর থেকে হাড় উদ্ধার এই প্রথম।
তার জন্যই এই নিয়ে প্রবল উচ্ছ্বসিত কানাডার ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনোসরের ডিম বিশেষজ্ঞ ডারলা জেলিনিটস্কি। এখনও অবধি এত সুন্দর ভাবে সংরক্ষিত ডিম তিনি আগে দেখেননি বলে জানিয়েছেন, এই সপ্তাহেই প্রকাশিত এই সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্রের মধ্যে। আইসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্র হইচই ফেলে দিয়েছে বিশ্বজুড়ে। তাই সেই ২০০০ সালে পাথর খননের সময় খুঁজে পাওয়া ডিম এতদিন সংস্থার এককোণে পড়ে থাকার পরে হঠাৎ করেই সকলের আগ্রহকে নিজের দিকে টেনে নিয়েছে রাতারাতি।
গবেষকরা বলছেন এই ডিমের ভিতরে থাকা ভ্রূণের জীবাশ্মটি আসলে অভির্যাপ্ট্রোসর নামে এক আকাশে উড়তে পারা ডাইনোসরের প্রজাতির। যারা বর্তমানে আকাশে উড়তে থাকা পাখিদের অনেকগুলি প্রজাতির পূর্বপুরুষ। ডিমের ভিতরে তাদের অবস্থান নাকি অনেকটাই এখনকার মুরগির ভ্রূণের মতো। মাথা এবং ডানার কাছে কিছুটা ফাঁকা জায়গা পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে ডিম ফুটে বেরিয়ে আসার সময় হয়ে গেছে তার।
এখন ভ্রূণ অবস্থায় তাদের খুঁজে পাওয়া, ডিমের ভিতরে এই ভ্রূণের কোলের কাছে মাথা গুঁজে শোওয়া, ফুটতে থাকা ডানা এবং পায়ের হাড়ের গঠন দেখে এদের বর্তমান বংশধরদের সাথে যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া আরও অনেকটা সহজ হয়ে যাবে বিজ্ঞানীদের কাছে। এর ফলে মিসিং লিঙ্ক হিসাবে খোঁজ মিলতে পারে আরও বহু প্রজাতির। এর আগে পাওয়া ভ্রূণগুলির সাথে এই ভ্রূণের গঠনের তুলনামূলক গবেষণায় উঠে আসতে পারে ডাইনোসর সম্পর্কিত অনেক নতুন তথ্য। যা হয়তো এখনকার জীবজগত সম্পর্কেও দেখাতে পারে নতুন দিশা।
প্রায় ১৩ কোটি বছর আগে জুরাসিক যুগে পৃথিবীর আকাশ দাপিয়ে বেড়াত এই অভির্যাপ্ট্রোসররা। তারপর স্বাভাবিক ভাবেই প্রায় সাড়ে ৬ কোটি বছর আগে অন্যান্য প্রজাতির ডাইনোসরদের মতো এদেরকেও বিলুপ্ত হয়ে যেতে হয়েছিল ধরাধাম থেকে। এখন আবার ফসিলের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থেকে অনেক কোটি বছর পরে দেখা দিল তাদের বহুকোটি পুরুষ পরের প্রজন্মকে। এখন সেই পাখিদের দাদুর দাদু তস্য দাদুর কাছ থেকে সেই যুগের আর কী কী গল্প শোনা যায় গবেষকদের মাধ্যমে সেটাই দেখার।
জানা গিয়েছে, আসলে ডিমটি ২০০০ সালে উদ্ধার হয়েছিল। এরপর সেটিকে সংরক্ষণ করে Yingliang Stone Natural History Museum-এ রাখা হয়েছিল। ২০১৫ পর্যন্ত এটি সংরক্ষণ করে রাখা ছিল। এরপর একজন কর্মী সেটার বিবরর্তন লক্ষ্য করেন। এরপর ওটিকে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্য়ালয়ের জীবাশ্মবিদদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁরাই গবেষণা করে উদ্ধার করেন দেখেন সেটি একটি ডায়নোসরের (Dinosaur) জিমের জীবাশ্ম। যার মধ্যে একটা আস্ত ভ্রুণ রয়েছে। যার আনুমানিক বয়স প্রায় ৭২ মিলিয়ন বা ৭ কোটি ২ লক্ষ বছর।