অন্য ধাতে গড়া এক সুপারস্টার

banner

#Pravati Sangbad Digital Desk:

জশ হ্যাজেলউডের ফুল লেংথ ডেলিভারি। ড্রাইভটা ছিল লং অনে। মিড অফে ফিল্ডার নেই, আশপাশে বলতে এক্সট্রা কাভারে একজন। বলটা বাউন্ডারি হবে তা একজন বাদে জানতেন গ্যাবার সবাই। ঋষভ পন্ত সেই একজন। সে জন্য পন্তকে সাক্ষী মানার প্রয়োজন নেই। ড্রাইভ খেলার পর তাঁর জীবনবাজি রাখা দৌড় সব বুঝিয়ে দেয়। মাথায় বাউন্ডারি নয়, ঘুরপাক খাচ্ছিল জয়ের সমীকরণ মেলানো, ৩ রান! তার আগে ১৩৭টি বল, উইকেটে থাকা ১৮০ মিনিট ধরে স্রোতের বিপরীতমুখী লড়াই করা পন্ত শেষ মুহূর্তেও দলের প্রয়োজনটা মাথায় রেখে দৌড়েছেন। ভীষণ রোমাঞ্চকর ও ঐতিহাসিক এক টেস্ট সিরিজে এই শেষ দৃশ্যটাও তো ফ্রেমে বেঁধে রাখার মতো। খেলাটা শুধু দলের জন্য!
কিংবা রুট নতুন বলের অপেক্ষায়, অ্যান্ডারসনকে ফ্রেশ রেখে মনে মনে হয়ত প্ল্যান করেছিলেন ডাবল স্ট্রাইকের! অথচ পান্ট ভেবে রেখেছিলেন ভিন্ন কিছু! প্রথম বলেই অ্যান্ডারসনকে স্টেপ আউট করে লফটেড বোলার্স ব্যাক ড্রাইভ! নতুন স্পেলের প্রথম বলেই এন্ডারসনের বিশ্বাসে চিড়! পুরো খেলার মোমেন্টামই বদলে গেল ওই এক ওভারে!
ধারাভাষ্য কক্ষে তখন সুনীল গাভাস্কার বলে যাচ্ছেন, শান্ত হও ইয়াং ম্যান, সেঞ্চুরি করতে পারার সুযোগ প্রতিদিন আসে না। আর বাইশ গজে হয়ত পান্ত ভাবছেন, ‘আশির দশক থেকে ক্রিকেট অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে স্যার!’
নব্বইয়ের ঘরে ব্যাট করা কোন ব্যাটসম্যান স্বয়ং জেমস অ্যান্ডারসনকে রিভার্স স্কুপ/সুইপ করবে, সেটাও আবার নতুন বলে, এমনটা হয়ত নিজের সবথেকে খারাপ স্বপ্নেও দেখেননি অ্যান্ডারসন! শটটা হয়ে যাবার পর, রুট এবং এন্ডারসনের চেহারাই বলে দিচ্ছিল পুরো সিনারিও।
আউট হতে পারতেন। নব্বইয়ের ঘরে আরও একবার কাটা পড়ে প্যাভিলিয়নে যাবার সময় কি ভাবতেন পান্ট? অনুশোচনা কি হত? সেঞ্চুরি হাতছাড়া হবার অনুশোচনা হয়ত হত না, তবে শটটা সঠিকভাবে খেলতে না পারার অনুশোচনা হত! বুনো সৌন্দর্য বলে একটা টার্ম লেখকেরা ব্যবহার করেন। ঋষভ পান্তকে কি সেটা বলা যায়? অথবা তার ব্যাটিংকে শিল্প? নাই বা বলা গেল সেগুলো, এন্টারটেইনার তো বলা যায়? তবে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে শব্দটা হয়ত ‘সেভিয়র’!

৪ঠা অক্টোবর ১৯৯৭সালে উত্তরাখণ্ডের রুরকিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম রাজেন্দ্র পন্ত। এবং তার মায়ের নাম সরোজ পন্ত। এই বয়সে শিশুরা সাধারণত প্লাস্টিকের খেলনা পছন্দ করে। কিন্তু এই বয়সে ঋষভ ক্রিকেট খেলতে এবং দেখতে খুব পছন্দ করতেন। ঋষভ, যিনি অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে নিজের আইডল মনে করতেন এবং ছোটবেলা থেকেই তিনি গিলক্রিস্টের মতো আক্রমণাত্মক উইকেট-রক্ষক ব্যাটসম্যান হতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু  ঋষভ পান্তের পথ চলা মোটেও সহজ ছিল না।প্রথম দিকে ক্রিকেট খেলার জন্য পন্তকে তার বাবা তিরস্কারও করেছিলেন।কিন্তু ঋষভের ক্রিকেটের প্রতি অনুরাগ দেখে ঋষভের বাবা তাকে ক্রিকেট খেলার অনুমতি দিয়েছিলেন।উত্তরাখণ্ডে ক্রিকেটের সুবিধা ভালো না থাকার কারণে ঋষভ দিল্লির একটি ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি হয়েছিলেন। হয়তো , এটি ছিল পন্তের সংগ্রামের আসল শুরু। তারপরের গল্প সকলেরই জানা । আসলে পন্থ সম্পর্কে বলতে গেলে সেই বিখ্যাত ক্রিকেটীয় বিশেষণগুলি আসে না , রাহুল দ্রাবিড়ের কপিবুক ডিফেন্সে যেমন আপনি একটি মুগ্ধতা ছড়ানো শিল্প উপভোগ করতে পারবেন, তেমনি নার্ভাস নাইন্টিজকে বুড়ো আঙুল দেখানো রিশভ পান্টের রিভার্স স্কুপ/সুইপে খ্যাপাটে তারুন্য দেখতে পাবেন! ক্রিকেট আপনাকে শিল্পীর সন্ধান দেবে যুগে যুগে। শিল্পীর শিল্পকে শুধু খুঁজে নেবার দায়িত্বটা আপনার!
একবার কাউন্টার অ্যাটাককে শিল্পের পর্যায়ে নিতে দেখেছিলাম অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসকে। খুব ডিফিকাল্ট পিচে অন্য ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতাকে আড়াল করতে সাইমন্ডস দাঁড়িয়ে যেতেন ঢাল হয়ে। ব্যাটিংকে হঠাৎ করেই সহজ মনে হত! প্রায় এক যুগ পর ঋষভ পান্ত নামের এক তরুণকে সেইম অথোরিটি নিয়ে খেলতে দেখছি। ফিয়ারলেস ক্রিকেটের ডেফিনিশন একেকজনের কাছে একেক রকম। পান্তের বর্তমান অ্যাপ্রোচকে আমি তাই শুধু ফিয়ারলেস টার্মে আটকে রাখব না। খ্যাপাটে অথচ ক্যালকুলেটিভ!

ডিফেন্সের ফাঁকফোঁকরগুলো ঢাকতে আক্রমণকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারার এই সক্ষমতা পন্থকে অপরিহার্য বানাবে। পান্ট আক্রমন করবে বিপক্ষ দল জানে, কিন্তু কখন করবে সেটা শুধু পান্টই জানে। এই আনসার্টেইনিটি বিপক্ষ দলের ক্যাপ্টেনকে ভাবতে বাধ্য করে, প্ল্যানে আমুল পরিবর্তন আনতে বাধ্য করে। আর এটাই তাকে বাকি ১১ এর থেকে পৃথক করে। আমরা ভারতীয়রা রাহুলের ব্যাটিংয়ে শিল্প দেখতাম, ভিভিএস লক্ষ্মণের ব্যাটিংয়ে ছন্দ, শচীন রমেশ টেন্ডুলকারের ব্যাটিংয়ে অথোরিটি, লারাতে আগ্রাসন, ওয়াহতে অলসতা, মাতারায় ধ্বংস! তবে আমি এবি ডি ভিলিয়ার্সে পুলকিত হয়েছি, কোহলিতে অবাক, আবার আমি জো রুটে দৃঢ়তা দেখেছি, কেইন উইলিয়ামসে নির্বাক!
শিল্পী আমি অনেক দেখেছি, তার শিল্পকে ধারন করেছি মনের মনি কোঠায়! তবে, আমি এন্টারটেইনার কম দেখেছি, ঋষভ পান্ত সবার মধ্যে একজন। কিছু ক্ষেত্রে বিরাট কোহলি বা স্টিভেন স্মিথ নয়, ঋষভ পান্তের ব্যাটিংই হয়ত আমি টিকিট কেটে দেখতে চাইব।

Journalist Name : Avijit Das

Related News