এক ক্রোয়েশিয় ম্যাজিসিয়ান

banner

#Pravati Sangbad Digital Desk :

একটা লোক, যে শুধু ফুটবলই খেলেছে তাঁর অর্ধজীবন ধরে, তার থেকে ঠিক কী কী এক্সপেক্ট করা উচিত? ধরা যাক লোকটা যদি পিয়ানো বাজাত, বা একেবারে এসব বাদ দিয়ে নিদেনপক্ষে একটা সামান্য মুদির দোকান চালাত, তাহলে তার থেকে কী কী এক্সপেক্টশন থাকত?
এই লুকা মদ্রিচ নামের ক্রোয়াট লোকটা যেন দিনকে দিন ঐ ধাঁচের হয়ে পড়ছে। সে তাকে যে রোলেই ফেলো, ওটাতেই মানিয়ে যাবে আরামসে। গল্পটা অনেকভাবে বলা যায়। অনেক স্তর থাকবে তাতে। চড়াই-উৎরাই, জাগ্রেবে ফ্ল্যাট খোঁজা থাকবে, থাকবে যুদ্ধের সময় বাড়ি ছেড়ে পালানো। গল্প বলার সময় যত এগোবে, আরও নতুন ঘটনাক্রম গল্পে যোগ হবে। কিছুদূর শুনতে শুনতে শ্রোতার কানে হঠাৎ প্রবেশ করবে এই ধরণের কথা – ‘The worst signing of this season for Real Madrid!’
সাড়ে ছত্রিশ বছর বয়সে ঐভাবে তিনটে ডিফেন্ডারকে ছিটকে সোলো রানটা ক্রিয়েট করা তো মুখের কথা নয়। লোকটা আদতে মিডফিল্ডার, হ্যাঁ সে একসময় কাকাও দৌড়তো। কিন্তু তা বলে সেটা সাড়ে ছত্রিশ বছর বয়সে নয়। অত স্প্রিন্ট টানার ক্ষমতা এল কোথা থেকে সেটা আজকের পর খুব জানতে ইচ্ছে করে মদ্রিচের কাছ থেকে। এই স্প্রিন্টের উৎসস্থল কোথায়? রাগ, কষ্ট, জেদ, নাছোড়বান্দা মনোভাব – কোনটা?
লুকা মদ্রিচ যেদিন রিটায়ার করবেন, সেদিন যেন ক্যারিয়ারের শেষ বয়সে এসে লিওনেল মেসিকে করা স্লাইডিং ট্যাকলের ছবিটা গোটা এরিনা জুড়ে থাকে। আর কিছু নয়, জাস্ট একটা উদাহরণ হিসেবে। মানুষই পারে, মানুষই পারে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে। জেদ এমনই ভয়ানক জিনিস।
স্কুলে পড়াকালীন জীবনে ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ডের মধ্যে থাকতে না পেরে এক অদ্ভুত শূন্যতা ভেতরে কাজ করত। কেন জানি না মনে হত, এটা জীবন নয়। হতেই পারে না। যেখানে তাবড় তাবড় কুশলীদের ভীড়ে নিজেকে পোডিয়ামে দেখতে পাচ্ছি না, মায়ের বকুনি আর পরীক্ষার খাতায় প্রণাম যার কিছুই ঠিক করতে পারছে না সে আবার কীসের জীবন!

এই চালচিত্র থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লেগেছে অনেকটা। ততদিনে স্কুল শেষ, কলেজ শুরুর দিকে। যারা পড়তে আসছে তাদের বেশিরভাগই সমুদ্রের অথৈতে পড়ে কুল হারাচ্ছে। এই একান্তে জীবনের প্রথম পর্যায়ের শেষে মনে হল আরেকটু বাঁচলে ভাল হয়। মদ্রিচ না এসেছে প্রথম-দ্বিতীয় হতে, না এসেছে তাকে নিয়ে করার অজস্র মজার প্রতিবাদ করতে, না এসেছে নিজেকে অদ্বিতীয় প্রমাণ করতে। মদ্রিচ সেসব অন্তঃসারশূন্য আলোচনায় থাকেনই না। এই বিরাট দুনিয়ার এককোণে ঘাপটি মারা শিল্পীগুলোকে মদ্রিচ নিজের কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছে গোটা ইউরোপ জুড়ে।
কখনও তা ক্রোয়েশিয়ার হয়ে আউস্টেপে সেতার বাজিয়ে গোল করছে, কখনও মাদ্রিদের গালিচায় মাখন লাগানো পাউরুটি সাজিয়ে দিচ্ছে সতীর্থের মুখের একদম নিকটে! মদ্রিচ সূর্যাস্তের আলোয় হেঁটে যাওয়া পথিকের মতো পথ খুঁজে ফিরছে সেই আদি-অনন্তকাল থেকে। পথেঘাটে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়ে যায় এক মুখ দাড়িওয়ালা, মুখে বিড়ির ধোঁয়া ওড়ানো পাগলদের। খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে একদিস্তে না ছাপা কবিতারা অবহেলায় পড়ে আছে চটের ব্যাগের মাঝে। কেউ যাদের খেতে দেয়নি অনেকদিন। সেই কবিতাদের ব্যাগ থেকে বার করে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে পড়েন মদ্রিচ। কখন যে কোন পংক্তিতে ভেসে ওঠে আমার হারিয়ে যাওয়া সেই মরীচিকার দিশা। কারণ? Giving up is not an option.
বুটের আগা দিয়ে রদ্রিগোকে বাড়ানো ওই পাসই রিয়ালকে ম্যাচে ফিরিয়েছে। যে পাসটি মদরিচ বাড়িয়েছিলেন, ফুটবলে এর চেয়ে নিখুঁত আর শৈল্পিক কিছু করা কি সম্ভব! ওই একটি মুহূর্তেই ছত্রখান চেলসির রক্ষণভাগ। ম্যাসন মাউন্ট, আন্তোনিও রুডিগার আর টিমো ভেরনারের তিনটি গোলে চেলসি যে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল, যে স্বপ্নের পথে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল তারা, কিন্তু মদরিচের পাসে সমতায় ফিরতে হয়।।মদরিচের ফুটবলে ৩৫ বছর বয়সের ধাক্কা এখনো বোঝা যায় না, সদ্য সমাপ্ত মৌসুমেও রিয়াল মাদ্রিদের মাঝমাঠে সৃষ্টিশীলতার প্রতিশব্দ হয়ে ছিলেন ক্রোয়েশিয়ান কিংবদন্তি। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার কোচ জ্লাতকো দালিচ যখন ২০২২ বিশ্বকাপের দল সাজাতে বসবেন, নিশ্চিত তাঁর দীর্ঘশ্বাস পড়বে মদরিচের বিকল্পের খোঁজে নেমে।

Journalist Name : Avijit Das

Tags:

Related News