অকালে খসে পড়া এক উল্কাকাহন!

banner

#Pravati Sangbad Digital Desk:

জমিদার বংশের রক্ত গায়ে থাকলেও সারাজীবন ভেবেছেন মানুষের সংগ্রাম নিয়ে, পীড়িত মানুষের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া অবস্থায় জড়িয়ে পড়েছিলেন ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে। বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। বাবার বদলীর চাকুরির কারণে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে দেশের নানা প্রান্তে। এক রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলেই তিনি ভর্তি হয়েছিলেন তিন তিনবার। শেষমেশ এখান থেকেই মেট্রিকুলেশন পাশ করেছিলেন। ৪৭’এর দেশভাগের সময় কলকাতায় পাড়ি দেয় তার পরিবার। রাজশাহী কলেজে পড়া অবস্থায় মাথায় ঢুকে গিয়েছিল নাটকের পোকা। প্রথম নাটক 'কালো সায়র' লেখেন ১৯৪৮-এ। প্রথম সিনেমার নাম 'নাগরিক'। ১৯৫২ সালে নির্মিত ছবিটি মুক্তি পায়নি এই গুণী পরিচালকের জীবদ্দশায়। মধ্যবিত্ত সমাজের জীবন জটিলতা, শহুরে জীবনের যন্ত্রণা, উদ্বাস্তু জীবন, বেকারত্বের ঘানি, আঁকড়ে ধরা হতাশা, শ্রেণী বিভাজনের কষ্ট, রাষ্ট্রের হাতে মানুষের পুতুল হয়ে পড়ার আবহই ছিল এই সিনেমার মূল উপজীব্য। এরপর টানা তিন বছরে শরণার্থীদের নিয়ে তার ‘ট্রিলজি’ নির্মাণ করলেন, ‘মেঘে ঢাকা তারা’(১৯৬০) ‘কোমল গান্ধার’(১৯৬১), আর ১৯৬২ সালে এলো ‘সুবর্ণরেখা’। 

শক্তিপদ রাজগুরুর কাহিনী অবলম্বনে 'মেঘে ঢাকা তারা' যেন নিঃসীম অন্ধকারে আলোর পথ দেখানোর ছবি, অদম্যভাবে বাঁচতে চাওয়ার আকুতিভরা ছবি। 'কোমল গান্ধার' সিনেমাতেও উঠে এসেছে সেই একই সুর- জীবনের জয়গান। দেশভাগ-উদ্বাস্তু ছেলেমেয়েদের নিয়ে নির্মিত নাটকের দলেও তীব্র বিরোধ। একদল ক্লাসিক নাটকের পক্ষে, অন্যদল চায় বাস্তবের মঞ্চ রূপ। 'সুবর্ণরেখা'র বিষয়বস্তুও ছিল সেই উদ্বাস্তু জীবনের গল্প। সাতচল্লিশের দেশভাগ মেনে নিতে পারেননি তিনি, তার প্রতিফলন দেখা যায় এই চলচ্চিত্রগুলোতে। 
তিনি ঋত্বিক ঘটক। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সবচাইতে প্রতিভাবান, এবং অবিসংবাদিতভাবেই, সবচেয়ে সৃজনশীল পরিচালকদের ছোট্ট তালিকার একজন। বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যেতে পারতেন যিনি। যাঁর সম্পর্কে খোদ সত্যজিত রায় বলেছিলেন- 'আরেকটু কম খামখেয়ালী হলে ঋত্বিক ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে বিশ্ব চলচ্চিত্র দরবারে রাজত্ব করতো।' ঋত্বিক ঘটক নামটা তাই কখনো নিদারুণ আক্ষেপেরও প্রতিশব্দ। 
ঋত্বিক বেড়ে উঠেছিলেন এক অদ্ভুত সময়ে। একদিকে দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা, যুদ্ধ-মন্বন্তর, পদ্মা-গঙ্গার জল লাল হলো মানুষের রক্তে; অন্যদিকে বারো মাসে তেরো পার্বণের বাংলা। এসব ঘটনার ঠিক মাঝখান দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে, বেড়ে উঠতে উঠতে একই সঙ্গে বেদনা আর সৃষ্টির সম্ভাবনাকে সঙ্গী করে দাঁড়িয়ে থাকা ঋত্বিক হাতিয়ার শিল্পকে বানিয়েছেন লড়াইয়ের। মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার, সুবর্ণরেখা, যুক্তি তক্কো গপ্পো তার এক একটি বিষবাণ। 


চলচ্চিত্র দিয়েই সমাজকে ধরতে চেয়েছেন ঋত্বিক, সময়কে বদলাতে চেয়েছেন, বলতে চেয়েছেন নির্যাতিতের অব্যক্ত হাজারো কথা। বঞ্চিত মানুষের কথা বলেছে তার চলচ্চিত্র। কখনোই চলচ্চিত্র দিয়ে বাণিজ্যটা করতে চাননি। তিনি ধাক্কা দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন জীবনের যাতনা, শিল্পের দ্যোতনা, মানুষের কষ্ট আর ব্যাথাকে মালায় গেঁথে তিনি বারবার উপস্থাপন করেছেন সেলুলয়েডে, ভিন্ন আঙ্গিকে। চলচ্চিত্র সম্পর্কে ঋত্বিক ঘটক বলতেন-
''আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাব যে, ইট ইজ নট এন ইমাজিনারি স্টোরি, বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে হাতুড়ি মেরে বোঝাব যে যা দেখছেন তা একটা কল্পিত ঘটনা, কিন্তু এর মধ্যে যেটা বোঝাতে চাইছি আমার সেই থিসিসটা বুঝুন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি, সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই আমি আপনাকে এলিয়েন্ট করব প্রতি মুহূর্তে। যদি আপনি সচেতন হয়ে ওঠেন, ছবি দেখে বাইরের সেই সামাজিক বাধা আর দুর্নীতি বদলের কাজে লিপ্ত হয়ে ওঠেন, আমার প্রোটেস্টটাকে যদি আপনার মধ্যে চাপিয়ে দিতে পারি তবেই ‘শিল্পী’ হিসেবে আমার সার্থকতা।'' বাহাত্তর থেকে তিয়াত্তর; এক বছর সময় নিয়ে নির্মাণ করলেন তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র- 'তিতাস একটি নদীর নাম'। অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাসকে অসামান্য দক্ষতায় সেলুলয়েডের ফিতায় বন্দী করলেন ঋত্বিক।
এই ছবি নির্মানের পরই শরীর ভেঙ্গে পড়তে থাকে। ওই সময় থেকেই খারাপ স্বাস্থ্য এবং অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে নিয়মিত কাজ চালিয়ে যাওয়া ঋত্বিক ঘটকের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সমালোচকরা বলে থাকেন-ঋত্বিক সিনেমার নেশায় কি পড়বে? বাংলা মদ আর বিড়ির ধোঁয়ার নেশায়ই তো বুঁদ হয়ে আছে!' তবে ব্যক্তি ঋত্বিকের নিন্দা করলেও, তার সিনেমাকে বরাবরই শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন সমালোচকরা। প্রশংসায় ভাসিয়েছেন তার সৃষ্টিকে। 

আগেও একাধিকবার স্বল্প সময়ের জন্য মানসিক ভারসাম্যও হারানো ঋত্বিক ঘটক পুরোপুরি বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়লেন শেষ ছবি 'যুক্তি-তক্ক আর গপ্পো'র পর। চিকিৎসার জন্য তাকে ভর্তি করা হলো মানসিক হাসপাতালে। স্মৃতি হারানো ঋত্বিক পরিবার-পরিজন আর শুভাকাঙ্খিদের কাউকেই চিনতে পারতেন না। 
জটিল সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় মাঝেমধ্যেই মারমুখী হয়ে উঠতে থাকলেন। জীবনের শেষ দিনগুলো তাকে কাটাতে হয়েছে মানসিক হাসপাতালের নির্জন প্রকোষ্ঠে। 
বলা চলে উল্কার মতোই জ্বলে ওঠে হুট করে নিভে যাওয়া এক খ্যাপাটে স্রষ্টা ছিলেন ঋত্বিক ঘটক। পাগলাগারাদের শেকল ভেঙ্গে মৃত্যুর মাঝে মুক্তি খুঁজে নেয়া এই মানুষটাকে একাত্তরে কলকাতার পথে পথে দেখা গেছে বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহের মিছিলে। দেশভাগ হয়েছিলো বটে, ঋত্বিকের মনটা ভাগ হয়নি কোনদিন। পদ্মার এপার-ওপার দুটোই তার কাছে ছিল সমান, নিজের মাটি হিসেবেই বিবেচনা করতেন দুটোকে। পরিচালক আসবে, পরিচালক যাবে। নির্মিত হবে হাজারো সিনেমা। কিন্তু আরেকজনকে এই মাটি আর কখনো পাবে না। ঋত্বিক ঘটকেরা তো একবারই জন্ম নেন, যুগে যুগে তো তারা আসেন না!

Journalist Name : Avijit Das

Related News