এক ইতিহাস সচেতন কবি

banner

#Pravati Sangbad Digital Desk:

একটা সময় রবীন্দ্রগগনে আলোকিত হয়ে ছিল গোটা ভারতবর্ষ, প্রখ্যাত বিখ্যাতরা কাব্যি টাব্যি নামাবার আগে জোড়াসাঁকোয় জোরহাতে ধুলো টুলো নিয়ে যান। বরিশালের এই ইন্টোভার্ট বছর সাতাশের যুবকও তার প্রথম গ্রন্থের খসড়া পাঠালেন ঠাকুরবাড়ির ডাকে; যদি তিনি দুচার প্রশংসা করেন তাহলে, প্রকাশককে রাজি করানো কমক্লেশ হবে। নোবেলজয়ী উত্তরে লিখলেন, "ভাষা নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝিতে পারিনে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদিকে পরিহাসিত করে!"
আর কোনোদিনই কাউকে মূল্যায়নের জন্য খসড়া পাঠাননি। বুঝেছিলেন কলিকেতার এলিটদের তোষামোদি বাবু বৃত্তে তিনি পরিত্যক্ত। অন্তর্মুখী ছিলেন এতোই তীব্র, ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা জামাকাপড়ে ছিটোতো কালি। একের পর এক কাব্যগ্রন্থ হয়েছে ফ্লপ। 'ক্যাম্পে' কবিতায় নাকি হেব্বি রসালো এরোটিকা! - এই অজুহাতে চাকরি কেড়েছে কলিকাতার কলেজ। ঘরে দিনরাত অনটনে অসহ্য ছিলো দাম্পত্য। পত্র পত্রিকায় দিনের পর দিন অকথ্য খিল্লি ওড়াতো সজনীকান্ত দাস। হতাশা দারিদ্র্যে একদা পালিয়ে গ্যাছেন কলকাতা ছেড়ে বরিশালে। 
একসময় সিটি কলেজে চাকরি করতেন। কিন্তু প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের কয়েক মাসের মধ্যেই চাকরি হারান তিনি। কলকাতায় আর কোনও কাজ না পেয়ে চলে যান বাগের হাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজে শিক্ষকতা করতে। তবে সেখানেও বেশিদিন নয়, মাত্র ২ মাস ২০ দিন পরেই ফিরে আসেন কলকাতায়। চূড়ান্ত আর্থিক সংকটে পড়ে একসময় গৃহশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সঙ্গে লেখালেখি থেকে হত সামান্য রোজগার। ১৯২৯ সাল দিল্লির একটি কলেজে চাকরি পান। কিন্তু সে চাকরি ছিল চার মাস। পরবর্তী সময়ে আরও বেশকিছু কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। কখনও আবার কাজ করেছেন বিমা সংস্থার এজেন্ট হিসেবে। ছোট ভাইয়ের থেকে অর্থ ধার করেছিলেন ব্যবসা করবেন বলে। কিন্তু কোনওদিনই পেশাগত দিক থেকে নিশ্চিন্ত হতে পারেননি তিনি। 

না, এত কিছুর পরও কবিতা লেখা থামাননি তিনি। থামাননি বলেই আধুনিক ও উত্তর আধুনিক বাঙালির কৃষ্টি কালচারে আর্টে ছত্রে ছত্রে থাকেন তিনি। লাখো লাখো শব্দ লয় উদ্ধৃতি নামে তার লাইন লাইনের কার্নিশ বেয়ে। থামাননি বলেই বাঙালি "হাজার বছর ধরে" পথ হাঁটে। থামাননি বলেই "মহিনের ঘোড়াগুলি" আজো ঘাস খায়। থামাননি বলেই কলকাতাও "কল্লোলিনী তিলোত্তমা" হয়! অন্ধকারে বাঙালির মুখোমুখি আজো বসে 'বনলতা সেন'!
তিনি জীবনানন্দ দাশ ,বাঙালির আইকন , ভারতের সর্বকালের সেরা কবি। তার বাবা ছিলেন সত্যানন্দ দাশগুপ্ত ও মায়ের নাম ছিল কুসুমকুমারী দাশ। তাই স্বাভাবিকভাবেই জন্মসূত্রে জীবনানন্দেরও পদবি ছিল 'দাশগুপ্ত'। কিন্তু একটা সময় পদবি থেকে 'গুপ্ত' বর্জন করে শুধুই 'দাশ' লেখা শুরু করেন তিনি। জীবনানন্দ দাশের মা গৃহবধূ হলেও কবিতা লিখতেন। তাঁর রচিত কবিতাগুলির মধ্যে অন্যতম হল 'আদর্শ ছেলে'। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে কবিতা ছিল জীবনান্দের রক্তে। এমনকি তাঁর শৈশবের শিক্ষাও শুরু মায়ের কাছেই। পরবর্তী সময় অবশ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম এ করেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনে লাবণ্য গুপ্তর সঙ্গে বিয়ে হয় জীবনানন্দ দাসের। তাঁদের দুই সন্তান, মঞ্জুশ্রী ও সমরানন্দ। অভিনেত্রী অপর্ণা সেন সম্পর্কে কবির ভাগ্নি। কারণ অপর্ণার মা ছিলেন জীবনানন্দের খুড়তুতো বোন। আর জীবনানন্দ দাস ছিলেন অপর্ণা সেনের 'বিলু মামা'।

তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী। রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থে যেভাবে আবহমান বাংলার চিত্ররূপ সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ হিসেবে খ্যাত হয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘নির্জনতম কবি’ এবং অন্নদাশঙ্কর রায় তাকে ‘শুদ্ধতম কবি’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন একজন কালসচেতন ও ইতিহাসচেতন কবি।
বিখ্যাত গ্রন্থগুলো: ঝরা পালক, ধূসর পাণ্ডুলিপি, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, রূপসী বাংলা, সাতটি তারার তিমির ইত্যাদি। তিনি ২১টি উপন্যাস এবং ১২৬টি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন।
জীবনানন্দ দাশ ১৯৫৫ সালে কলকাতায় এক ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হন, পরে ২২ অক্টোবর মারা যান।

Journalist Name : Avijit Das

Related News