টেস্ট টিউব বেবি সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য

banner

#Pravati Sangbad Digital Desk:

ভারতে কৃত্তিম উপায়ে প্রজনন বিদ্যার পথপ্রদর্শক ছিলেন প্রয়াত কিংবদন্তী বন্ধ্যাত্বরোগ বিশেষজ্ঞ বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী। শুক্রবার, বাংলা নববর্ষের দিন বেলা সাড়ে ন’টা নাগাদ তিনি সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা প্রয়াত হন। 
বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর প্রতিষ্ঠিত আইআরএম অর্থাৎ ইনস্টিউট অব রিপ্রোডাকটিভ মেডিসিনে সুলভে আইভিএফ পদ্ধতিতে লক্ষ মহিলা সাফল্যের সঙ্গে তাঁদের সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। সন্তানলাভে আজ খুশি সেই সকল মা। ভারতে কৃত্তিম উপায়ে প্রজনন অর্থাৎ নলজাতক গবেষণা এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন অগ্রগণ্য। ভারতে প্রথম টেস্ট টিউব বেবির সৃষ্টিকর্তা সুভাষ মুখোপাধ্যায়। অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিলেন ভারতের প্রথম টেস্ট টিউব বেবির সৃষ্টিকর্তা সুভাষ মুখোপাধ্যায়। যদিও পরবর্তীতে ভারতে কৃত্তিম উপায়ে প্রজনন অর্থাৎ নলজাতক গবেষণা এবং  চিকিৎসার ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন অগ্রগণ্য। 

১৯৬৭ থেকে ১৯৭৬-এই দীর্ঘ নয় বছর ধরে তিল তিল করে এন আর এসেই গবেষণাগার তৈরি করেছিলেন সুভাষবাবু। পরে বদলি হওয়ার পর বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজে যোগ দিলেও সপ্তাহান্তে কলকাতার বাড়িতে ফিরে হাসপাতালের ছোট পরীক্ষাগারেই গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন সুভাষবাবু। আর সেই যুগান্তকারী গবেষণার ফলই কানুপ্রিয়া। কানুপ্রিয়ার বাবা যখন সুভাষবাবুর কাছে তাঁদের অসুবিধার কথা জানিয়েছিলেন, “তিনি নতুন পদ্ধতিতে আমাদের উপর পরীক্ষা করতে চান। তাতে যে শিশু জন্মাবে সে বিকলাঙ্গ হলেও হতে পারে।” বেলা দেবী অর্থাৎ কানুপ্রিয়ার মায়ের পরীক্ষা করে সুভাষবাবু দেখেছিলেন, বেলা দেবীর দুটি ফ্যালোপিয়ান টিউবই অবরুদ্ধ। তখনই তিনি নিজের নতুন গবেষণা “টেস্ট টিউব বেবি’র” পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন ওই দম্পতির উপরে। আর এর পরই নিঃসন্তান দম্পতির কোল আলো করে আসে কানুপ্রিয়া আগারওয়াল(দুর্গা)। যার জন্ম ১৯৭৮সালের ৩রা অক্টোবর। 

বর্তমানে এই পদ্ধতির মাধ্যমে ‘মা’ হচ্ছেন অনেক নারী। তবে এখনও সাধারণ মানুষের মনে এই “টেস্ট টিউব বেবি” অনেক ভ্রান্ত ধারণা আছে। অনেকেই মনে করেন এই টেস্ট টিউব বেবির জন্ম হয় টেস্ট টিউবের মধ্যেই। আসলে তা নয়। টেস্ট টিউব বেবির জন্য সংগ্রহ করা হয় ডিম্বাণু আর শুক্রাণুর নিষেক ঘটে ল্যাবটরিতে। আর ল্যাবটরি মানেই একগাদা টেস্ট টিউব ভর্তি। লাতিন আমেরিকার গবেষকরা তাই কাঁচের টিউবগুলির সঙ্গে মিলিয়ে নাম দিয়েছিলেন ‘ইন ভিট্রো’(লাতিন ভাষায় ভিট্রো মানে টেস্ট টিউব)। সেখান থেকেই টেস্ট টিউব বেবির জন্মের প্রক্রিয়ার নাম হয়ে যায় ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন এবং সংক্ষেপে জাকে বলে আইভিএফ। এই পদ্ধতিতেই বন্ধ্যা নারী ও পুরুষ সন্তানের মা-বাবা হতে পারেন। 
>টেস্ট টিউব বেবি নেওয়ার পূর্ব প্রস্তুতিঃ
চিকিৎসার খরচ, সফলতা-ব্যর্থতা সম্পর্কে জানানো হয়।
স্বামি-স্ত্রীর রক্তের সুগার টেস্ট করা হয়।
পুরুষের বির্য পরীক্ষা করা হয়।
যৌন রোগের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়।
স্ত্রীর মাসিকের দ্বিতীয় দিনে হরমোনের পরীক্ষা করা হয়।
এইচবিএস এন্টিজেন, ট্র্যান্সভ্যাজাইনাল আলট্রাসোনগ্রাম, হিমোগ্লোবিন, বুকের এক্সরে
টেস্ট-টিউব বেবির জন্ম পদ্ধতিঃ
টেস্টটিউব শিশু সৃষ্টির সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি প্রধানত ৭টি ধাপে সম্পন্ন হয়।
স্টেপ ১- কৃত্তিম হরমোন প্রয়োগ 
মাসিকের ২১তম দিন থেকে বা প্রথম দিন থেকে একনাগাড়ে ১০-১৫দিন স্ত্রীকে FSH বা GnRH ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়। GnRH হরমোন প্রভাবে ডিম্বাশয়ের বিভিন্ন কোষ যারা ডিম্বাণু উৎপাদন কাজে অংশগ্রহণ করে কাজ শুরু করার জন্য উত্তেজিত হয় এবং ডিম্বাণু তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন হরমোন ক্ষরণ করতে শুরু করো। FSH হরমোনের প্রভাবে ডিম্বাশয়ের ভেতর অবস্থিত অপক্ক ডিম্বাণু কোষ বা ফলিকল কোষ ডিম্বাণু সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু করে। এরপর ডিম্বাশয়ের ফলিকলগুলো পরীক্ষা করার জন্য আলট্রাসোনাগ্রাফি ও ব্লাড টেস্ট করা হয়। 

স্টেপ ২: ডিম্বাণু পরিপক্ক করা
দ্বিতীয় ধাপে পূর্বোক্ত পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে প্রথম ইনজেকশনের সাথে এইচসিজি বা হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রোফিন হরমোন পুশ করা হয়। এই হরমোন গুলোর প্রভাবে ইস্ট্রোজেন হরমোন ক্ষরিত হয় এবং পরিপক্ব ডিম্বাণু তৈরি হয়। ডিম্বাণু পরিপক্ব হলে ১ম ও ২য় ইনজেকশন দুটো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২৪ ঘণ্টা পর LH হরমো ন ইনজেকশন দেওয়া হয়। এই হরমোনের প্রভাবে ডিম্বাণু পরিপক্ক হয়ে নিষেকের জন্য প্রস্তুত হয়। ৩:     স্টেপ ৩- ওভাম বা ডিম্বাণু কালেকশন
তৃতীয় ইনজেকশন দেওয়ার ৩৪-৩৬ ঘণ্টার মধ্যে আলট্রাসনােগ্রামের মাধ্যমে ডিম্বাশয় পর্যবেক্ষণ করে ল্যাপারােস্কোপির সাহায্যে তলপেটে ছোট্ট ছিদ্র করে সূক্ষ্ম মাইক্রোইনজেকশন দ্বারা ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয়।অনেকসময় ছোট্ট অপারেশনের মাধ্যমে ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয়। এই সময় স্ত্রীকে অজ্ঞান করে নেওয়া হয় অথবা ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়।
এ পর্বটি ২০-৩০ মিনিটের মধ্যে সম্পন্ন হয়। সাধারণত ৬-১০ টি ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত ডিম্বাণু ইনকিউবেটরে স্ত্রীদেহের মত উপযুক্ত পরিবেশে সংরক্ষণ করা হয়। এসময় ডিম্বাণুর জন্য কৃত্রিম পুষ্টি পদার্থের ব্যবস্থা করা হয়।
 স্টেপ ৪: স্পার্ম কালেকশন
জীবাণুমুক্ত একটি পাত্রে স্বামীর শুক্রাণু বা স্পার্ম সংগ্রহ করা হয়। শুক্রাণুর কোন ত্রুটি থাকলে তা দূর করা হয়।গবেষণাগারে শুক্রাণুকে বিভিন্ন ওষুধ
দিয়ে পরিষ্কার করা হয়।সংগৃহীত শুক্রাণুকে উপযুক্ত পরিবেশে সংরক্ষণ করা হয় যাতে এদের মৃত্যু না ঘটে।

 স্টেপ ৫: নিষিক্তকরণ
একটি টেস্টটিউব বা অন্য কোন সুবিধামতো মাধ্যমে  সংগৃহীত ডিম্বাণুর সাথে শুক্রাণুকে একটি টেস্টটিউবে নিয়ে ইনকিউবিটারে ২৪-৪৮ ঘণ্টা রেখে দেওয়া হয়।এ অবস্থায় ইনভিট্রোতে নিষেক ঘটবে এবং ক্লিভেজ চলতে থাকবে এবং নিষিক্ত ডিম্বাণু প্রাথমিক ভ্রূণে পরিণত হতে থাকবে। শুক্রাণুর নিষিক্তকরণ ও চলার ক্ষমতা কম থাকলে এভাবে নিষিক্ত হয় না তখন Intracytoplasmic sperm injection (ICSI) পদ্ধতির সাহায্য নেয়া হয়।
এ প্রক্রিয়ায় ইনজেকশনের মাধ্যমে ডিম্বাণুর সাইটোপ্লাজমে শুক্রাণুর নিউক্লিয়াস প্রবেশ করানো হয়। বয়স্ক বা বেশ কয়েকবার বিফল হওয়া মহিলাদের ক্ষেত্রে Assisted hatching এর সাহায্য নেয়া হয়।
একটি টেস্টটিউব বা অন্য কোন সুবিধামতো মাধ্যমে  সংগৃহীত ডিম্বাণুর সাথে শুক্রাণুকে একটি টেস্টটিউবে নিয়ে ইনকিউবিটারে ২৪-৪৮ ঘণ্টা রেখে দেওয়া হয়।এ অবস্থায় ইনভিট্রোতে নিষেক ঘটবে এবং ক্লিভেজ চলতে থাকবে এবং নিষিক্ত ডিম্বাণু প্রাথমিক ভ্রূণে পরিণত হতে থাকবে। শুক্রাণুর নিষিক্তকরণ ও চলার ক্ষমতা কম থাকলে এভাবে নিষিক্ত হয় না তখন Intracytoplasmic sperm injection (ICSI) পদ্ধতির সাহায্য নেয়া হয়।
এ প্রক্রিয়ায় ইনজেকশনের মাধ্যমে ডিম্বাণুর সাইটোপ্লাজমে শুক্রাণুর নিউক্লিয়াস প্রবেশ করানো হয়। বয়স্ক বা বেশ কয়েকবার বিফল হওয়া মহিলাদের ক্ষেত্রে Assisted hatching এর সাহায্য নেয়া হয়।

 স্টেপ ৬ : ভ্রূণ প্রতিস্থাপন
এই পর্যায়ে জরায়ুতে ভ্রুণ প্রতিস্থাপন করতে হবে। ৪৮ ঘণ্টা পর স্ত্রীর বয়সের অনুপাতে ৪-৮ কোষাবশিষ্ট ২-৩টি সর্বোত্তম ভ্রূণ স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করা হয়। একটি ক্যাথেটারের মাধ্যমে যোনিপথের ভেতর দিয়ে জরায়ুতে ভ্রূণ স্থানান্তর করা হয়।
এটি খুব সহজ ও ব্যথামুক্ত পদ্ধতি।একটু সিডেটিভ প্রয়োগ করলেই চলে স্ত্রীকে অজ্ঞান বা অচেতন করার প্রয়ােজন পড়ে না। ভ্রূণ জরায়ুর ভেতরের প্রাচীরে বা এন্ডোমেট্রিয়ামে দৃঢ়ভাবে যুক্ত হয় একে ইমপ্লান্টেশন বলে।
ইমপ্লান্টেশন এর পরে ৯-১২ সপ্তাহের মধ্যে প্লাসেন্টা বা অমরা সৃষ্টি হয়। ভ্রূণ অমরার মাধ্যমে খাদ্যগ্রহণ শুরু করে। এরপর সময়ের সাথে সাথে ভ্রূণ একটি পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুতে পরিণত হয়। জরায়ুতে ভ্রুণ ভালোভাবে বেরে উঠার জন্য প্রজেস্টেরণ,ইস্ট্রোজেন, এইচসি হরমোনের কৃত্রিম ডোজ প্রয়োগ করা হয়।
 স্টেপ ৭: পরিচর্যা
সবক’টি ধাপ শেষে ১৫ দিন পর রক্ত পরীক্ষা করা হয়। ফলাফল পজিটিভ হলে আরও ১৫ দিন পর ইউএসজি করে গর্ভধারণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। পুরাে প্রক্রিয়াটি চলাকালীন সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যেমন-
হাসিখুশি ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হবে।
পুষ্টিকর খাবার খেতে হব
ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
ভাঙ্গা রাস্তা যেখানে প্রচুর ঝাঁকুনি হয় সেখানে যানবাহনে উঠা যাবে না।
ভারিকাজ একদম করা যাবে না
যৌনসংগম যতটা সম্ভব পরিহার করতে হবে।

Journalist Name : Aditi Sarker

Related News