স্বদেশী আন্দোলন থেকে দূষণ রোধে নীরব কর্মী, সুলেখা আজও গৌরবান্বিত

banner

#Pravati Sangbad Digital Desk:

বাঙালি দেশ প্রেম যে কতখানি গভীরতায় ইতিহাসের পাতা উল্টালেই জানা যায়। কিন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে ময়দানে নেমে যুদ্ধ না করে ও দেশপ্রেমিক হওয়া যায় তাও বাঙালিরা করে দেখিয়েছে তাদের বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে। দেশপ্রেম ও স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়াইয়ের এমনই এক সাক্ষ্য হলো সুলেখা কালি। কলকাতা জাদবপুর সুলেখা মোড় কমবেশি সকলেই পরিচিত । এই নামের কারণ দু চার লাইনে আজকালকার ছেলেমেয়েরা জানে। কিন্তু এর পিছনের ইতিহাস হয়তো অজ্ঞাত।

সালটা তখন ১৯৩০। গান্ধীজীর নেতৃত্বে স্বদেশী আন্দোলনের উত্তেজনায় তখন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। গোটা দেশ ইংরেজ বয়কট এ শামিল হচ্ছে। বিদেশি পণ্যের বদলে দেশি পণ্য ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে ভারতবাসী। সেই সময় গান্ধীজীর পরামর্শে জন্ম দেশীয় কালির। ব্রিটিশদের ঝরনা কলম ত্যাগ করে সহজেই জায়গা করে নিল সুলেখা কালি। রাজশাহীর স্বাধীনতা সংগ্রামী অম্বিকাচরণ মৈত্র এবং সত্যবতী মৈত্র এর সুযোগ্য দুই পুত্র ননীগোপাল ও শঙ্করাচার্য মৈত্র মা-বাবার আদর্শকে পাথেয় করে স্বদেশী শিল্প গঠনের দিকে মনোযোগ দেন।


বেঙ্গল কেমিক্যালস এর চিপ কেমিস্ট তথা মুক্তিযোদ্ধা সতীশচন্দ্র সামন্ত তার তৈরি কৃষ্ণ ধারা কালের ফর্মুলা তুলে দেন ননীগোপাল মৈত্রের হাতে। এরপর ১৯৩৪ সালে পথচলা শুরু সুলেখা কালির। প্রথম দিকে বাজারে এর নাম প্রফেসর মৈত্রের কালী রূপে প্রচলিত হলেও ভালো লেখা হয় বলে এর নামকরণ করা হয় সুলেখা। মৈত্র পরিবারের সকলে এই ব্যবসায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। হেমেন্দ্র মোহন বসু এর বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল এ লিখেছিলেন "সুলেখা কালি। এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।"  সুলেখার নামকরন কে করেছিল তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও বলা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা ছিল বেশি।


প্রথমে মৈত্র বাড়ির মহিলারা এই কালি তৈরি করলেও চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে ১৯৩৮ সালে বউ বাজারে, ১৯৩৯ সালে কসবা ও ১৯৪৬ সালে যাদবপুরে এই কোম্পানি স্থানান্তরিত হয়। এই কোম্পানির নামেই 'সুলেখা মোড়' নামাঙ্কিত। ব্যবসা বাড়তে থাকলে সারা ভারতে জোগান দেওয়ার জন্য সোদপুর এবং উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদে আরো দু'টি ইউনিট খোলা হয়েছিল।


১৯৮৮ সালে নানা কারণে বন্ধ হয়ে যায় সুলেখা। তবে হাল ছাড়েনি। ২০০৬ সালে আবার ননীগোপালের নাতি কৌশিক মৈত্রর হাত ধরে প্রত্যাবর্তন করে সুলেখা। তবে মূল ব্যবসার পাশাপাশি হল পার্সোনাল হাইজিন কেয়ার সৌর বিদ্যুতের সরঞ্জামও তৈরি করে। মহামারী কালে পিপিই কিট ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও উৎপাদিত হতে লাগে।

তবে প্রশ্ন ছিল কালি উৎপাদন কি বন্ধ? উত্তর কৌশিক মাত্র জানান যে গত কয়েক বছরে কালির চাহিদা বেড়েছে। তাই কালি উৎপাদন বন্ধ হয়নি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অনলাইনেও পাওয়া যাচ্ছে সুলেখা কালি। চাহিদা হয়তো খুব বেশি না কিন্তু মানুষ এখনও মনে রেখেছে। বলপেনের সহজলভ্যতার ঝরনা কলম এ দু - চার পাতা আঁকিবুকি কাটলেও একসময় সাহিত্য রচিত হয়েছে এই কালির আঁচড়ে। সত্যজিৎ রায় ফেলুদা গল্প সিনেমাতে সুলেখা কালি কে বিশেষ স্থান দিয়েছেন।


এ কথা বলা বাহুল্য স্বাধীনতাযুদ্ধে যেমন স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করেছিল সুলেখা কালি আজ স্বাধীনতার এত বছর পরেও পরিবর্তিত যুগ এর পরিবর্তিত সমস্যার সমাধানে আবারও যোগদান করছে এই সংস্থা। বর্তমান যুগের প্রধান সমস্যা দূষণ। আর একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বলপেন জমে পরিবেশ দূষণ ঘটায় নিরন্তর। আত্মনির্ভর ভারত ও দূষণ রোধে কালের ব্যবহারের প্রচলন ঘটাতে আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ও স্কুল গুলির সাথে যোগাযোগ করছে সুলেখা কালি। কালির ব্যবহার দূষণ রোধে সহায়ক। এছাড়াও বিদ্যুতের ব্যবহার সম্পর্কেও সুলেখা যথেষ্ট সচেতন। কলকাতার একমাত্র সুলেখার দোকানে ( সুলেখা মোড়, যাদবপুর ) সৌর শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ আসে। কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে এই প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতার সময় থেকে আজ নীরবে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। হয়ত একেই বলে দেশপ্রেম!

Journalist Name : Satarupa Karmakar

Related News