Flash news
    No Flash News Today..!!
Monday, May 6, 2024

থিয়েটার, সিনেমা, শিল্প এবং সৌমিত্র...

banner

#Kolkata:

"আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই; 

দূরে যাবে তুমি,

দেখা হবে না আর কোনদিনই।" –

গত বছর আজকের দিনে দীর্ঘ এক যাত্রার পর পরের স্টেশনে নেমে গিয়ে আর দেখা না হওয়ার দেশে চলে গেছেন তিনি। তাপসী (১৯৬৩), নামজীবন (১৯৭৮), রাজকুমার (১৯৮৩), ফেরা (১৯৮৭), নীলকণ্ঠ (১৯৮৮), ঘটক বিদায় (১৯৯০), দর্পণে শরৎশশী (১৯৯২), চন্দনপুরের চোর (১৯৯৪), টিকটিকি (১৯৯৫) আরও আরও অনেক নাটকের ঝুলি যার ঝোলায় ভর্তি থাকতো সেই মানুষটার নামই ছিলো সৌমিত্র। সৌমিত্র চট্টোাধ্যায়।থিয়েটারের কাছে নতজানু হয়ে আত্মসমর্পণ করা এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যাঁরা সৌমিত্র বাবুর সাথে কাজ করেছেন তাঁরা জানতেনই যে থিয়েটারের শো - ডেট বাঁচিয়ে তবেই শ্যুটিং-এর শিডিউল ঠিক করতেন তিনি। তাঁর এই সিদ্ধান্তটিকে অসমর্থন করার মতো ক্ষমতা ছিলো না কারোরই।

আসলে প্রত্যেকেই জানতেন যে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের যুগসন্ধিক্ষণের প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। তার একধারে ছিলো গিরিশচন্দ্র ঘোষ, শিশিরকুমার ভাদুড়ির মতো নাট্যকার, প্রশিক্ষক প্রমুখরা আর অন্যদিকে ছিলেন শম্ভু মিত্র,উৎপল দত্ত , অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ত্রয়ী।প্রথম যুগের নাম ছিল “পাবলিক থিয়েটার” এবং দ্বিতীয় যুগের ডাকনাম “গ্রুপ থিয়েটার”। কয়েকশো বছর ধরে নিজেদের দাপট বজায় রাখার পর এরা প্রত্যেকেই বর্তমানে ম্লান হয়ে স্টার বা মিনার্ভা থিয়েটার ওদিকে একাডেমী অফ্ ফাইন আর্টসের মধ্যে কণারুপ ধারণ করে আছে।কিন্তু বিগত পাঁচ দশক ধরে এই সমান্তরাল ধারাতেই অনায়াসে অক্লান্ত এবং অবিরত যাতায়াত করেছেন সৌমিত্রবাবু।


অবশ্য বাংলার সংস্কৃতিকে আপন করে নেওয়া এই মানুষটি থিয়েটার করার জন্য সকল শক্তি আহরণ করতে সক্ষম যে ছিলেনই তা আলাদা করে বলতে লাগে না। তারওপর শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ীকে।

তখনকার দিনে থিয়েটারের সাথে বাঙালির সম্পর্ক অনেকটা নিবিড় ছিলো। পাড়ায়, কলেজে উৎসবের খাতিরেই দু-তিনটি করে নাটক প্রযোজনা চলতই, সে তার গুণগত মান যত খারাপই হোক না কেনো! তাঁদের কৃষ্ণনগরের বাড়িতেই বসতো নাটকের আখড়া। কিন্তু এতো কিছুর মাঝেও বেশ কয়েকবছর শিশিরবাবুর কাছে নাটকের হাতেখড়ির অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনের চূড়ান্ত পালাবদল ছিলো। ছাত্রের বুকে নাট্যপ্রেমের বীজ বপন করার নিপুণতার বিষয়ে বারবারই স্বীকার করেছেন সৌমিত্র। এই নিয়ে লেখাপত্তরও আছে অনেক।


কিন্তু শিষ্য গুরুকে একসাথে নাটক মঞ্চস্থ করতে দেখেনি এই যান্ত্রিক শহর। তবে মার্কাস স্কোয়ারে বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনের দরবারে “প্রফুল্ল” নাটকে শিশিরকুমারের পাশে একবারই অভিনয় করেছেন তিনি। তখনও সৌমিত্রবাবুর অপুর সংসার করা হয়নি।

তিনি কি নাটক করেছিলেন, তার গল্প তার প্রযোজনা এইসব নিয়ে বলতে শুরু করলে, এই হাজার বা দুহাজার শব্দসীমায় বেঁধে দেওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না। যদিও বা বাঁধা যায় সেই ক্ষমতা এখনও আমার হয়নি। কত গল্প শুনেছি,এই শুনছিলাম যেমন নান্দীকারের প্রখ্যাত অভিনেতা অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখেছিলেন নিজে থেকে রবীন্দ্রসদনে নাট্যোৎসব করবেন বলে। তাঁরা তিন মহারথী উৎপলবাবু,অনুপবাবু ও তিনি মিলে। আবার শুনেছি ১৯৭৩ নাগাদ করে স্বজনবান্ধবদের নিয়ে দল গড়ে নাটক করার তোড়জোড় করেছিলেন। পাশে পেয়েছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে উৎপল দত্তের মতো থিয়েটার - সিনেমার সঙ্গীদের।


কিন্তু এই সৌমিত্রবাবু যে থিয়েটারের প্রতি তাঁর সৃজনশীলতায় আরও অনেক বেশি দায়বদ্ধ ছিলেন, সে কথার খবর আজকাল কম লোকই রাখেন। সিনেমায় তিনি শুধু অভিনিয় করতেন। কিন্তু থিয়েটারে তার মনোনিবেশ ছিলো  কয়েকগুন বেশি। প্রসেনিয়াম থিয়েটারের চরম প্রয়োজনীয় দুটি দিক - লেখা ও পরিচালনা উৎভয়েই সাফল্য পেয়েছিলেন।

আসলে তাঁর শিক্ষকের সান্নিধ্য তাঁকে থিয়েটারের দুটি ধ্রুব সত্য বুঝিয়ে গিয়েছিল। এক থিয়েটারের জাদুবল আছে “ এন্টারটেইনমেন্ট ভ্যালুতে” এবং দুই বিশ শতকের পশ্চিমী দুনিয়ার মতো মেথড অ্যাক্টিং আমাদের দেশের জন্য না। আমাদের দেশে বরাবরই “রিডিং বিটুইন দ্য লাইনস” চরিত্রায়নের মূলমন্ত্র।


তবে সময়ের কালে বুঝতে পারছিলেন যেসব নাটকগুলোতে তাঁকে শুরু থেকে শেষ অবধি মঞ্চে উপস্থিত থাকতে হতো সেই শক্তি শারীরিকভাবে ক্ষয় হচ্ছিলো এবং এই ইঙ্গিত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেরী করেননি সেই স্থান ছেড়ে দিতে। “আত্মকথা” বা “ছাড়িগঙ্গা”র মতো নাটকের কেন্দ্র থেকে সরে এসেছিলেন পার্শ্ব চরিত্রে। কিন্তু যেটুকু পাঠ নিতেন দর্শক সম্পূর্ণ নাটকের পরও সেই অংশটুকুর বিশেষ স্মৃতি নিয়ে বাড়ি যেতেন।

আসলে এই অতিমারির আকস্মিক পদার্পণ নাহলে মঞ্চ থেকে এখনও বিদায় নেওয়ার কথা ছিল না তাঁর। যতদিন এগিয়েছে পাবলিক থিয়েটার থেকে গ্রুপ থিয়েটারের দিকে সরে গিয়েছিলেন। একটু জোড়ে পা দিলেই নড়ে যাওয়া স্টেজ, আলো কম এলোমেলো গ্রিন রুম কিছুর পরোয়া না করে শিল্পটাকে আগলে গিয়েছিলেন। শুনেছিলাম এই শীতে দুটো নাটক তাঁর পাকা কথাতেই ছিলো, এক “ফেরা” দুই “ঘটক বিদায়”, দুটিই দেশীয় ঘরনায় বিদেশি নকশার ছিলো।


Journalist Name : Srijita Maitra

Tags:

Related News