#Pravati Sangbad Digital Desk:
শিল্পির কর্মে তাঁর ব্যক্তি জীবনের ছাপ রয়ে যায়। শিল্প এমন এক পরিসর, যেখানে নিজেকে আড়াল করার উপায় থাকে না। তাই চলচ্চিত্রে চরিত্র বাছাইয়ের বৈচিত্র্য, অনন্যতা তাঁর যাপিত জীবনেও দেখতে পাই। সামন্ততান্ত্রিক পরিবারে জন্ম। বাবা ছিলেন শিকারি, তাই বাবার হাত ধরেই শিকারে হাতেখড়ি তাঁর। কিন্তু শিকারের ভয়াবহতা তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। স্কুলে চুপচাপ থাকতেন বলে, তাঁকে নিয়ে মজাও করত সবাই।
ইরফান খান তার অভিনয় দক্ষতা দিয়ে ভিন্নধর্মী সিনেমা করার চেষ্টা করতে থাকলেও তার ঝুড়িতে একের পর এক ফ্লপ সিনেমা সংযুক্ত হতে থাকে প্রথমদিকে। কিন্তু হঠাৎই দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে যায়। ব্রিটিশ ফিল্ম ডিরেক্টর আসিফ কাপাডিয়া তাকে তার “দ্য ওয়ারিয়র” সিনেমার জন্য প্রধান চরিত্রে মনোনীত করলেন। আসিফ কাপাডিয়া সে সময় ছিলেন কান ফিল্ম ফেস্টিভালে পুরস্কার পাওয়া পরিচালক। পরবর্তীতে তিনি বাফটা অ্যাওয়ার্ড, অস্কার বা একাডেমী অ্যাওয়ার্ড, এমনকি গ্র্যামী অ্যাওয়ার্ডও জয় করেন। তার নির্মিত “অ্যামি” সিনেমাটি যুক্তরাজ্যের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ডকুমেন্টারি ফিল্ম। দ্য ওয়ারিয়র” ছিল ইতিহাসভিত্তিক একটি সিনেমা। সিনেমাটি বানাতে ১১ সপ্তাহ সময় লেগেছিল। সিনেমাটির পুরো শ্যুটিং হয়েছিল ভারতের হিমাচল প্রদেশ ও রাজস্থানে। ২০০১ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে দ্য ওয়ারিয়র মুক্তি পায়। বাফটা অ্যাওয়ার্ডে এটি সেরা ব্রিটিশ ফিল্মের পুরস্কার জিতে নেয়। অস্কারের জন্য যুক্তরাজ্য থেকে যে সিনেমাটি পাঠানো হবে, তার সংক্ষিপ্ত তালিকাতেও এই সিনেমাটি জায়গা পেয়েছিল। এরপরই ইরফান রাতারাতি এক পরিচিত মুখ হয়ে যান।
২০০৪ এ খান রোড টু লাদাখ নামে একটি শর্টফিল্মে অভিনয় করেন তিনি। এই শর্টফিল্মটি আন্তর্জাতিকভাবে বেশ প্রশংসিত হয়। এর ফলে এই শর্টফিল্ম থেকেই পরিচালক একটি ছবি নির্মাণ করেন, যাতে ইরফান খান প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। একই বছরে তিনি মকবুল নামে আরেকটি সিনেমায় অভিনয় করেন। এটি ছিল শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথের অ্যাডাপ্টেশান। এতে তিনি নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এই সিনেমাটিও সমালোচকদের কাছে বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। ২০০৪ সালে বলিউডের হাসিল নামের আরেকটি সিনেমায় তিনি ভিলেনের চরিত্রে অবতীর্ণ হলেন। সিনেমাটিতে তার অভিনয় সমালোচকদের বিস্ময়ে স্তব্ধ করে দেয়। এই সিনেমার জন্য ইরফান ফিল্মফেয়ার সেরা ভিলেনের পুরস্কার জিতে নেন।
মুক্তি পেল ‘লাইফ অব পাই’। হলে গিয়ে দেখলাম সে ছবি। মুগ্ধ হলাম। শুধু সিনেমা দেখেই নয় বরং অল্প সময়ের সাদামাটা উপস্থিতিতে ইরফানের অনন্যতা দেখে। চলচ্চিত্রটিতে টাকার বড় অংশ লগ্নি হয়েছিল কোনো গ্ল্যামার নয়, নাচ নয়, গান নয়, শুধু অভিনেতাদের দক্ষতা আর ভিজ্যুয়াল ইফেক্টের ওপরে আর প্রথম সপ্তাহের শেষে ছবিটির আয় দাঁড়িয়েছিল ১৯.৫ কোটি রুপি। ইরফান কিন্তু টাকার মাপকাঠিতে মাপতে চাননি কোনো চলচ্চিত্র আর অভিনেতাকে। এ ধরনের মাপকাঠিকে তিনি বাজে প্রবণতা মনে করতেন। অর্থ আর জনপ্রিয়তাকে তিনি বলতেন অভিনয়ের ‘বাইপ্রডাক্ট’।
২০০৮ সালে ইরফান খান স্লামডগ মিলিয়নিয়ারে এক পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় করেন। সিনেমাটি বেস্ট পিকচার, বেস্ট ডিরেক্টরসহ ৮টি ক্যাটাগরিতে অস্কার জিতে নেয়। এছাড়া ৭টি বাফটা অ্যাওয়ার্ড ও ৪টি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডও আছে এই সিনেমার ঝুড়িতে। এই সিনেমার জন্য তিনি এবং সিনেমার অভিনেতারা স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড অ্যাওয়ার্ড ফর আউটস্ট্যান্ডিং পারফর্মেন্স বাই আ কাস্ট ইন আ মোশান পিকচার অ্যাওয়ার্ড জয় করেন। স্লামডগ মিলিয়নিয়ারের অস্কারজয়ী পরিচালক ড্যানি বয়েল ইরফান খান সম্বন্ধে বলেছেন, “ইরফান একই অভিনয় বারবার একইরকম নিখুঁতভাবে করতে পারেন। এটা দেখতে পারা সত্যিই অসাধারণ।”
২০০৯ সালে ইরফান খান অ্যাসিড ফ্যাক্টরি নামে একটি সিনেমায় অভিনয় করেন। এটি অ্যাকশনধর্মী সিনেমা ছিল। তিনি সিনেমাটি করার পর বলেছিলেন ভবিষ্যতে আরো এরকম অ্যাকশনধর্মী সিনেমায় অভিনয় করতে চান।
এ বছরই ইরফান নিউইয়র্ক এবং নিউইয়র্ক, আই লাভ ইউ নামের দুটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন ইরফান। নিউইয়র্ক সিনেমায় তিনি এফবিআই এজেন্টের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সিনেমাটি বক্স অফিসে হিট হয়। ২৩ কোটি রুপির বাজেটের বিনিময়ে সিনেমাটি বক্স অফিসে ৬৫ কোটি রুপির ব্যবসা করে। কায়রো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল এবং পুসান ইন্টারন্যাশনাল ফিম ফেস্টিভালেও সিনেমাটির স্ক্রিনিং হয় ।
২০১১ সালে ইরফান খানকে ভারত সরকার তার অসাধারণ অভিনয়ের জন্য পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত করে। পদ্মশ্রী ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা।
২০১২ সালে হলিউড মুভি দা আমেজিং স্পাইডারম্যান ইরফান খান ড. রাজিত রাথা চরিত্রে অভিনয় করেন। তিনি হলিউডের সিনেমা লাইফ অব পাইয়ের পাই চরিত্রটির পূর্ণবয়স্ক চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। লাইফ অব পাই অ্যাকাডেমী অ্যাওয়ার্ড বা অস্কারে ১১টি ক্যাটাগরীতে মনোনয়ন লাভ করেছিল, যা ২০১২ সালে অন্য যেকোনো সিনেমার চেয়ে বেশি ছিল। চারটি ক্যাটাগরীতে অস্কার পুরস্কারও জিতে নিয়েছিল ছবিটি। তিনটি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডে মনোনয়ন পেয়ে বেস্ট অরিজিনাল স্কোরের জন্য একটি গোল্ডেন গ্লোব জেতে সিনেমাটি। এছাড়াও এই সিনেমা ২টি ব্রিটিশ অ্যাকাডেমী ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডও জিতেছে।
২০১২ সালে ইরফান খান বলিউডে পান সিং তোমার নামে আরেকটি সিনেমায় অভিনয় করেন। সিনেমাটি সমালোচকদের কাছ থেকে অসাধারণ প্রশংসা পায়। সিনেমাটিতে ভারতের ন্যাশনাল গেমে স্বর্ণপদক পাওয়া একজন সৈনিকের খেলোয়াড় থেকে ডাকাতে পরিণত হওয়ার সত্য কাহিনীর উপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হয়েছিল। সাড়ে চার কোটি রুপিতে নির্মিত এই সিনেমাটি বক্স অফিসে প্রায় ৩৯ কোটি রুপির ব্যবসা করে। এই সিনেমার জন্য ইরফান খান ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা অভিনেতার পুরস্কার জেতেন যা বলিউড কাঁপানো তিন খানের কেউই কখনও জেতেননি। এ থেকে আমরা তার অভিনয়ের গভীরতা সম্বন্ধে ধারণা করতে পারি। ফিল্মফেয়ারে তিনি সমালোচকদের মতে সেরা অভিনেতার পুরস্কারটিও জিতে নেন।
২০১৩ সালে তিনি দ্য লাঞ্চ বক্সের জন্য এশিয়ান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডে সেরা অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন।এছাড়াও গুন্ডা , হায়দার এসব সিনেমাতেও তার অভিনয় নজরকাড়া ।২০১৫ সালে ইরফান খান অমিতাভ বচ্চন ও দীপিকা পাড়ুকোনের সাথে পিকু সিনেমায় প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেন। ৩৮ কোটি রুপির বাজেটে নির্মিত সিনেমাটি বক্স অফিসে ১৪১ কোটি রুপির ব্যবসা করে। এভাবেই ইরফান খান শুধু তার অভিনয় দিয়ে সমালোচকদের মন জয় করেননি, বক্স অফিসেও ছোট ছোট সিনেমা দিয়ে রাজত্ব করতে শুরু করলেন।
বলিউডের মূল স্রোত থেকে গা বাঁচিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে এমন সম্মান এবং তারই পথ ধরে জনপ্রিয়তা ইরফানই প্রথম অর্জন করেছিলেন। নিয়ম ভেঙে নিজের মতো করে নিয়ম গড়া ইরফানের প্রিয় কাজ ছিল।
দেখিয়েছেন চলচ্চিত্র বিক্রি-বাট্টার জন্য মেধা আর গল্পকে দূরে সরিয়ে কীভাবে গেড়ে বসেছে অশ্লীলতা আর চটুল কনটেন্ট।
তার পুরো নাম সাহেবজাদে ইরফান আলী খান। পরে চলচ্চিত্র শুরু করেন ইরফান খান নামে। অনেকেই তাঁকে সেরা খান বলছেন। অথচ শেষের দিকে নিজের নাম থেকে খান নামটি বিযুক্ত করেছিলেন তিনি। বলতেন ধর্ম আমার আর ইশ্বরের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, এটাকে প্রকাশ্যে জানানোর প্রয়োজন কী? আরও বলেছিলেন, বংশ নয় বরং নিজ পরিচয়ে পরিচিত হতেই ভালো লাগে তাঁর। তাই এই বিযুক্তিকরণ। ভারতীয় মিডিয়া যখন ইরফানকে ‘নিউ কিং খান’ আখ্যা দিচ্ছে, এমন সময় নাম থেকে খান বিযুক্তিকরণ দেখে মনে হতে থাকে, বলিউডে অজস্র ‘খান’ (আমির, শাহরুখ, সালমান, সাইফ) দের ভিড়ে, আরেকজন ‘খান’ হিসেবে স্টার হওয়ার ইঁদুর দৌড়কে প্রত্যাখ্যানই করেছিলেন হয়তোবা।
নেমসেক’ চলচ্চিত্রটি ইরফানের মা সাঈদা বেগম দেখেছিলেন। ছবি শেষে ইরফানকে আলাদা ডেকে বলেছিলেন, তিনি চলচ্চিত্রের পরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে চান। ইরফান অবাক। কেন দেখা করতে চান জানতে চাইলে সাঈদা বলেন, ছবির মধ্যে মেরে ফেলার জন্য আমার ছেলেকেই তাঁর বাছতে হলো? বিষয়টা তার মোটেও ভালো লাগেনি। সেই মায়ের সঙ্গে প্রায় একই সময়ে, অজানায় পাড়ি জমিয়েছিলেন ইরফান। এপারে শেষ দেখা হয়নি, হয়তো ওপারে হয়েছে। ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রের তারা হয়ে ওঠা ইরফান হঠাৎই কোনো সুযোগ না দিয়েই আকাশের তারা হয়ে গেলেন।
Journalist Name : Avijit Das