পশ্চিম মেদিনীপুরের নাড়াজোলের ঐতিহাসিক রাজবাড়ী

banner

#West Midnapore:

ইতিহাস অনেক সময় নানান রহস্যের সৃষ্টি করে । বিশেষত কোনও রাজবাড়ির প্রাচীন ইতিহাস যে কোনও মানুষকে আকর্ষিত করে। আমাদের বাংলায় বিশেষভাবে পরিচিত বহু রাজবাড়ির সন্ধান পাওয়া যায় । তাদেরই মধ্যে অন্যতম হলো নাড়াজলে রাজবাড়ি।

এই রাজবাড়ী ট্রেনে ও সড়কপথে দুইরকম ভাবেই যাওয়া যায়। ট্রেনে যেতে হলে হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেন ধরে পৌঁছে যান পাশকুড়া স্টেশন। স্টেশন থেকে টোটো নিয়ে সম্পূর্ণ নাড়াজলে যাওয়া যায়। আর সড়কপথে যেতে হলে কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে ১১৫ কিমি পথ অতিক্রম করে পৌঁছে যেতে পারেন নাড়াজলে।


প্রায় ১৫ শতকে রাজা উদয় নারায়ণ ঘোষ নাড়াজলে  এই রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠা করেন। এই উদয় নারায়ণ ঘোষ  ছিলেন,বর্ধমানের রাজা ঈশ্বর ঘোষের উত্তরাধিকার। শোনা যায় একদা রাজা উদয় নারায়ণ শিকারের জন্য নাড়াজলে আসেন। সেই সময় তিনি জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে এক অলৌকিক ঘটনার সম্মুখীন হন । তিনি দেখেন মায়াবী আলোয় পরিপূর্ণ একটি স্থানে একটি বকপাখি এক বাজ পাখিকে আক্রমণ করছে । ঘটনাচক্রে সেই দিন রাতেই রাজা উদয় নারায়ণ দেবী দুর্গার স্বপ্নাদেশ পান । এই ঘটনার পরই তিনি সেই স্থান থেকে প্রচুর ধনসম্পত্তি এবং একটি দূর্গামূর্তি লাভ করেন। পরবর্তী কালে এই ধনসম্পত্তির সাহায্যেই উদয় নারায়ণ এই রাজবাড়ি নির্মাণ করেন।

পরবর্তী কালে উদয় নারায়ণের পোপৌত্র রাজা কার্তিকরামকে তৎকালীন মুঘল সম্রাট 'রায়' উপাধিতে ভূষিত করেন। এই বংশের প্রায় আট প্রজন্ম রায় উপাধি দ্বারাই পরিচিত ছিলেন। কিছুকাল পর রাজা বলবন্ত তার কার্যের জন্য ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেন। আর সেই কারণেই তিনি পরবর্তীকালে 'খান' উপাধিপ্রাপ্ত হন। 


নাড়াজলে রাজবাড়ি প্রায় ৩৬০ বিঘা জমির উপর অবস্থিত । এই রাজবাড়ির আনাচে কানাচে লুকিয়ে ইতিহাসের গন্ধ। এমনকি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এই রাজবাড়ির সদস্যরা প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। আর তাই মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ব্যক্তিত্বরা এই রাজবাড়িতে এসেছিলেন। বর্তমানে এই রাজবাড়ি যত্নের অভাবে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। ইতিহাসের স্মৃতিবিজড়িত এই রাজবাড়ির দর্শনীয় স্থান রয়েছে। সেগুলি হলো -

১. এই রাজবাড়িতে মোট ২৫০ টি কক্ষ রয়েছে। তবে সেগুলি সবই সঠিক পরিচর্যার অভাবে আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। তবে ইতিহাসের পাতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে জানা যায়, সেই সময় এই রাজবাড়ি নির্মাণের জন্য জয়পুর, লাহোর ইত্যাদি স্থান থেকে কারিগরদের আনা হয়েছিল।

২. বাম দিকে রয়েছে গোবিন্দ জিউ মন্দির, সীতারাম জিউ মন্দির এবং একটি প্রসস্থ ঠাকুর দালান। এই গোবিন্দ জিউ মন্দিরটি সেই সময় এই বংশের উত্তরধিকার সীতারাম খান প্রায় ২৫০ বছর আগে নির্মাণ করেন। প্রায় ৫০ফুট উচ্চতা সম্পন্ন এই গোবিন্দ জিউ  মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছেন রাধা-কৃষ্ণ। তবে ভগ্নপ্রায় এই মন্দিরের বিগ্রহ আজ প্রতিষ্ঠিত আছে সীতারাম জিউ মন্দিরে।

রাজা মোহনলাল খান ১৮১৯ সালে সীতারাম জিউ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। শোনা যায় মন্দির নির্মাণের জন্য সেই সময় শিলাবতী নদীর সাহায্যে অযোধ্যা থেকে বেলে পাথর নিয়ে আসার ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। এছাড়াও মন্দির নির্মাণের জন্য প্রায় ১লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল। এই মন্দিরে রাম, সীতা, ভরত, শত্রুঘ্ন, এবং মহাবীরের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত আছে। মন্দির সংলগ্ন সম্পূর্ণ ঠাকুর দালানটি লোহা, এবং বেলজিয়াম গ্লাসের সমন্বয়ে নির্মিত।

৩.রাজবাড়ির অন্দরে রয়েছে নাটমন্দির এবং দূর্গামন্দির। প্রায় ২৭ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন এই দূর্গামন্দিরটি সেই সময় পঞ্চরত্ন মন্দির হিসেবে পরিচিত ছিল।

নাড়াজলে রাজবাড়ির বংশধর রাজা মোহনলাল খান একটি হওয়া মহল নির্মাণ করেন। এই হওয়া মহলটিকে বাগানবাড়ির আখ্যা দিলেও কোনো ভুল হবে না। সেই সময় রাজাদের মনোরঞ্জনের জন্য এখানে নর্তকীরা আসতেন।


 ১৮১৮ সালে রাজা মোহনলাল খান একটি বিশাল পুস্করিণীর মধ্যবর্তী স্থানে প্রায় ৬০ বিঘা জমির উপর একটি মহল নির্মাণ করেন, যা লঙ্কাগড় জলহরিৎ নামে পরিচিত। মূলত গ্রীষ্মের সময় মনোরম পরিবেশে বাস করার জন্যই এই মহল নির্মাণ করা হয়। সেই সময় এই মহল বানাতে খরচ হয়েছিল প্রায় ৬০ হাজার টাকা। রাজবাড়ি থেকে লঙ্কাগড় জলহরিৎ এর দূরত্ব প্রায় ১কিমি।

এছাড়াও এখানে ৪০ফুট উচ্চতা সম্পন্ন রাস মঞ্চ, প্রাচীন শিব মন্দির, শিলাবতী এবং কাঁসাই নদীর দর্শন পাবেন। তবে ১৫ শতকের এই এতো ঐতিহ্যপূর্ণ রাজবাড়ী আজ প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

Journalist Name : Sangita Rana

Related News