রবিবাসরীয় ব্রিগেড মঞ্চ থেকে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বাংলার ৪২ আসনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে তৃণমূল৷ শুধুমাত্র নিজের কেন্দ্র বাদে বাকি ৪১টি কেন্দ্রের নামই ঘোষণা করেন অভিষেক ৷ ৪২ কেন্দ্রের ৪২ প্রার্থীকে সঙ্গে নিয়ে র্যাম্পেও হাঁটেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷
কিন্তু, এবারের তালিকায় যেমন প্রথম বারের মতো যুক্ত হয়েছে রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, সায়নী ঘোষ, দেবাংশু ভট্টাচার্যের মতো নতুন নাম যুক্ত হয়েছে, তেমনই বাদ গিয়েছে বহু পরিচিত পুরনো নামও৷
সাম্প্রতিক অতীতে যখন তৃণমূলের অন্দরের নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব তখন এই প্রার্থীতালিকা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
একদিকে যেমন পচাত্তর বছর বয়সি সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, ছিয়াত্তর বছর বয়সি সৌগত রায়, সাতষট্টি বছর বয়সি কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো পোড় খাওয়া, অভিজ্ঞ, বর্ষীয়ান রাজনীতিকদের ফের একবার বেছে নেওয়া হয়েছে সংসদীয় রাজনীতিতে দলের ব্যাটন সামলানোর জন্য। অন্যদিকে আবার সাতাশ বছরের দেবাংশু ভট্টাচার্য, বছর একত্রিশ সায়নী ঘোষদের মতো দলের নতুন প্রজন্মকেও সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে লোকসভা ভোটে লড়াইয়ের জন্য। পঞ্চায়েত ভোটে নিজের লড়াকু মনোভাবে দলীয় নেতৃত্বের মন জয় করা সুজাতা মণ্ডলও এবার প্রার্থী হয়েছেন লোকসভায়। ভোট ময়দানে এখনও পর্যন্ত অপরীক্ষিত ছোট পর্দার ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও এবারের লোকসভা ভোটে প্রার্থী করেছেন মমতা।
বীরভূমের সাংসদ শতাব্দী রায়ও একসময় টলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন। বহু ছবির মুখ্য চরিত্রে দেখা গিয়েছে তাঁকে। সেই শতাব্দীকে ইতিমধ্যেই বহুবার ফোন করেছেন রচনা। শতাব্দীর সঙ্গে নিজেকে তুলনা করতে রাজি নন রচনা। তিনি বলেন, “উনি দারুণ একজন কর্মঠ মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে দলের সঙ্গে যুক্ত আছেন। তাঁর থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সম্মানীয় একজন রাজনীতিক। ওঁর থেকে অনেক কিছু জানব, শিখব। এরমধ্যেই ২৫ বার ফোন করা হয়ে গিয়েছে। আবার করব। পাগল করে দেব ওঁকে।”
রুপোলি পর্দার মতো ভোট ময়দানেও ১০০ শতাংশ দিয়ে কাজ করতে চান রচনা। তবে অভিনয় বা শো-এর থেকে রাজনীতির ময়দান অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন তিনি। রচনা বলেন, “দিদি নম্বর ওয়ানের মতোই এখানেও মানুষের মন জয় করতে পারব বলে আশা করি।”
সুদীপ বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের কাছে উত্তর কলকাতার রাজনীতি হাতের তালুর মতো চেনা। দমদম লোকসভা কেন্দ্রের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা সৌগত রায়ের জন্য। আবার শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতিক ও আইনি অভিজ্ঞতাও তৃণমূলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই তাঁদের উপর ফের একবার ভরসা রাখল তৃণমূল, এমনটাই মত ওয়াকিবহাল মহলের। পাশাপাশি লোকসভার সংসদীয় রাজনীতিতেও তাঁদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা নতুনদের চলার পথে দিশা দেখাবে বলেও মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
যাদবপুর কেন্দ্র উনিশের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলপ্রার্থী ছিলেন অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী৷ তবে সম্প্রতি নিজের সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে রাজনীতি ছাড়ার ইচ্ছেপ্রকাশ করেছিলেন মিমি৷ যদিও তেমন জল্পনা তৈরি হয়েছিল দেবকে নিয়েও৷ কিন্তু, দেবের সঙ্গে কথা বলে মিটমাট করে নিয়েও মিমির ক্ষেত্রে তেমনটা কিছু ঘটতে দেখা যায়নি৷ ঘাটাল কেন্দ্র থেকে দেব ওরফে দীপক অধিকারীর নাম ঘোষণা করলেও যাদবপুর কেন্দ্র থেকে বাদ পড়েছে মিমি চক্রবর্তীর নাম৷ বদলে এসেছে তৃণমূল যুবনেত্রী তথা অভিনেত্রী সায়নী ঘোষের নাম৷
ফ্ল্যাট বিতর্কে ইডির তলব থেকে শুরু করে সন্দেশখালি কাণ্ডে অনুপস্থিতি৷ সব মিলেই হয়ত বসিরহাট কেন্দ্র থেকে বাদ পড়েছে নুসরত জাহানের নাম৷
দক্ষিণ ২৪ পরগণার মথুরাপুর কেন্দ্র থেকে বাদ পড়েছে চৌধুরী মোহন জাটুয়ার নাম৷
বর্ধমান পূর্ব লোকসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল এবারে প্রার্থী করেছে ডঃ শর্মিলা সরকারকে৷ বাদ গিয়েছে সুনীল মণ্ডলের নাম৷
নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে তাঁর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গিয়েছিলেন বিজেপি নেতা তথা আইনজীবী তরুণজ্যোতি তিওয়ারি৷ তার উপরে স্থানীয় সংগঠনেও ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছিলেন অপরূপা পোদ্দার৷ জল্পনা চলছিল, এবার হয়ত আরামবাগ কেন্দ্রে অন্য কোনও মুখের খোঁজ করছে তৃণমূল৷ রবিবার ঘোষিত প্রার্থী তালিকায় আরামবাগ কেন্দ্র থেকে অপরূপা পোদ্দার নয়, মিতালি বাগের নাম ঘোষণা করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব৷
তবে, বাদের তালিকায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম ভাটপাড়ার অর্জুন সিং৷ এবার ব্যারাকপুর থেকে তৃণমূলের প্রার্থী হচ্ছেন রাজনৈতিক মহলে অর্জুন বিরোধী হিসাবে পরিচিত নৈহাটির তৃণমূল বিধায়ক পার্থ ভৌমিক৷
ব্যারাকপুরে তৃণমূলের প্রার্থী হলেন রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক। লোকসভায় টিকিট জুটলো না অর্জুনের। যদিও টিকিট না পেয়ে তাঁর দাবি, ‘ কোনরকম হতাশ নেই। সময় এলে জবাব দেব।’
এখন প্রশ্ন কোন অঙ্কে টিকিট পেলেন পার্থ ভৌমিক? বিজেপি ছেড়ে আসলেও অর্জুনকে কেনো প্রার্থী করলো না তৃণমূল? তৃণমূলের অন্দরের খবর, ২০১৯ এ যখন কালীঘাটে তৃণমূল সুপ্রিমোর বাড়িতে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হয় সেখানে নাম ছিল না অর্জুনের। টিকিট না পেয়ে সেজন্য কালীঘাটে থেকে বেরিয়েই সোজা দিল্লী রওনা হন অর্জুন। পরের দিন দিল্লির অফিসে বিজেপিতে যোগ দেন অর্জুন। এরপর অনেক জল গড়িয়েছে।
অর্জুনের নিজের এলাকা বলে পরিচিত ভাটপাড়া কেন্দ্রে অর্জুন সিং এর পুত্র পবন সিংবিজেপির বিধায়ক। শিল্পাঞ্চলে গুঞ্জন অর্জুন সিং নিজ পুত্রকে বিজেপিতে রেখে সে দলে ফের ঢোকার পথ তৈরি রেখেছেন। আলোচনায় উঠে আসছে, যদি তাঁকে বিজেপি না নিতে চায় তাহলে পুত্রকে সামনে রেখেই তৃণমূলের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ চালাবেন অর্জুন সিং।
অর্জুন সিং বলছেন, প্রার্থী হবার বিষয়ে দলই বলেছিল। তিনি ইঙ্গিতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশান করে বলেন, দলের টপ টু-এর সঙ্গেই কথা হয়েছিল। বিশ্বাসঘাতকতা করা হল। উত্তর ২৪ পরগনার শিল্প শহর জুড়ে তীব্র আলোচনা এবার সাংসদ অর্জুন সিং ফের বিজেপিতে ঢুকতে চলেছেন।
এবার বাংলার শাসকদলের তুরুপের তাস তরতাজা প্রায় ১০ প্রার্থী। এঁরা সকলেই ভোট ময়দানে প্রথমবার লড়ছেন। কেউ আবার দিল্লির লড়াইয়ে নবাগত। আর এঁদের উপরই দিল্লি জয়ের ভার দিলেন তৃণমূল (TMC) সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেদিক থেকে এই তালিকায় চমক রয়েছে যথেষ্টই। পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে সংগঠন তৈরিতে যাঁরা দক্ষতা দেখিয়েছেন, লোকসভায় তাঁদের প্রার্থী করে ‘পুরস্কার’ও দিয়েছেন নেত্রী। তালিকায় যেমন সমাজের বিশিষ্ট মানুষজন রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন দলের একনিষ্ঠ কর্মীরা।
রবিবারের ব্রিগেড (Brigade) সমাবেশে অধিকাংশটাই ছিল চমকে ভরা। যেমন মঞ্চের সঙ্গে র্যাম্প, সেই র্যাম্পে হাঁটতে হাঁটতে অভিষেকের বক্তব্য রাখা, প্রার্থী ঘোষণা, তাঁদের র্যাম্পে এনে এলইডি স্ক্রিনে পরিচয় করানো – সবেতেই অভিনবত্ব। বিশেষভাবে নজরকাড়া এবার প্রার্থী তালিকা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন, ঘোষণা করলেন দলের ‘সেনাপতি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ৪২ আসনেই একাধিক নতুন নাম শোনা গেল তাঁর মুখে।
নবাগত মুখের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আইপিএস (IPS) প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান। প্রথমজন সদ্যই সময়ের আগে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। রায়গঞ্জ রেঞ্জের আইজি ছিলেন প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক জগতে তাঁর অবাধ বিচরণ। নিজের নাট্যদল রয়েছে। তাঁকে মালদহ উত্তর (Maldah Uttar) থেকে প্রার্থী করল তৃণমূল। ওই আসনের লড়াই অত্যন্ত আকর্ষণীয় হতে চলেছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। মালদহ দক্ষিণেও ঘাসফুল শিবিরের প্রার্থী নবাগত।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে দেবাংশুকে প্রার্থী করা হল তমলুকে। ইতিমধ্যেই সেখানে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নামে দেওয়াল লিখন শুরু হয়ে গিয়েছে। সেখানে বিজেপি প্রার্থী হওয়া প্রায় নিশ্চিত। ফলে এখানে একেবারেই দুই নতুন মুখের লড়াই হবে। দেবাংশু রাজনীতিতে কিছুটা অভিজ্ঞ, আর অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কেরিয়ার শুরু এক সপ্তাহও কাটেনি। তমলুকের মাটি যেমন, তাতে গেরুয়া হাওয়া প্রবল থাকলেও দেবাংশুর মতো তরুণ নেতা যে লড়াইয়ে ভালো বেগ দেবেন, তা মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তমলুকের পাশের কেন্দ্র কাঁথিতেও নতুন প্রার্থী তৃণমূলের। জেলা পরিষদের সভাধিপতি উত্তম বারিক এবারের লোকসভা ভোটের টিকিট দেওয়া হল। বিষ্ণুপুরের প্রার্থী সুজাতা খাঁ।