ইতিহাসের পাতা উল্টালে বহু যুদ্ধের কথা জানা যায়। যে যুদ্ধে জয় পরাজয় লাভ-ক্ষতি থাকে আর থাকে আত্মাভিমান রক্ষা ও চেষ্টার গল্প। প্রবাদ আছে একবার না পারিলে দেখো শতবার, কিন্তু যুদ্ধ এমন এক জিনিস যা শতবার চেষ্টা করা বোকামি। কিন্তু দেশ রক্ষার্থে শত্রুর মোকাবেলা যতবার করতে হোক না কেন সেই বিষয়ে পিছু হটতে নারাজ ছিলেন ভারতীয় বীর সম্রাটেরা। তবে ইতিহাস কাকে মনে রাখে? জয়ী না পরাজয়ী কে? এই প্রশ্ন খুব জটিল হলেও একথা সত্য যে বারবার চেষ্টা করেও পরাজিত হওয়ার নাম খুব একটা মনে রাখেনা ইতিহাস! তবে ব্যতিক্রম আছে।
পেশোয়ার এর যুদ্ধ এমনই এক দ্বন্দ্বের যুদ্ধ যেখানে পরাজয়ী বারবার চেষ্টা করেও পরাজিত হন শেষ অব্দি আত্মহননের পথ বেছে নেন। ১০০১ সালের কথা, ভারতের পাঞ্জাব ও গান্ধার রাজ্য মিলে সেকালের কাবুল শাহির সম্রাট জয়পাল যুদ্ধ ঘোষণা করেন গজনবী সাম্রাজ্যের সম্রাট মোহাম্মদ গজনীর বিরুদ্ধে। বর্তমানের তাজাকিস্তান, পশ্চিম ইরান ও উত্তর আফগান নিয়ে বিস্তৃত ছিল সেকালের গজনীর সাম্রাজ্য। মোহাম্মদ গজনী হলেন তিনি যিনি ২৬ বছরে মোট ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেছিলেন।
ঘটনার সূত্রপাত হয় গজনীর কান্দাহার জয়ের পর।একের পর এক যুদ্ধ জয়ের পর গজনী ভারতের দিকে দৃষ্টিপাত করবেন তা বুঝতে পেরে হিন্দু শাহী রাজ্য কাবুল শাহীর রাজা জয়পাল আক্রমণ করে বসেন গজনী কে। সেই যুদ্ধে তিনি পরাজিত হন। মোটা অংকের মুক্তিপণের পরিবর্তে তার জীবন দান করেন গজনী। পরবর্তীকালে তিনি নিজের স্বাধীনতা ফেরাতে কর দেওয়া বন্ধ করে দেন এবং এক লক্ষ সৈনিক নিয়ে ফের আক্রমণ করেন এবং পুনরায় পরাজিত হন। বর্তমান পূর্ব আফগানিস্তানের একটি অংশ বিধ্বস্ত হয় এবং কাবুল জালালাবাদ গজনী সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়। তবে ক্ষান্ত দেন নি জয়পাল। ১০০১ সালে তিনি আবারও সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। এই সময় মোহাম্মদ গজনী ১৫ হাজার অশ্বারোহী বাহিনী এবং অসংখ্য আফগান সৈন্য নিয়ে পেশোয়ার পৌঁছান। অপরদিকে রাজা জয়পালের ছিল ১২ হাজার অশ্বারোহী ৩০ হাজার পদাতিক এবং ৩০০ টি হাতি। বর্তমান পাকিস্তানের পেশোয়ারে ১০০১ সালের ২৭ শে নভেম্বর জলের মধ্যে যুদ্ধ লাগে। এই যুদ্ধই পেশোয়ার এর যুদ্ধ নামে বিখ্যাত।
আল- ইবতী রচিত 'তারিখ ইয়ামিনি' গ্রন্থে সাম্রাজ্য ও কাবুল শাহীর যুদ্ধের ইতিহাস বর্ণিত আছে। গজনী প্রথমে আক্রমণ করলে জয়পাল অশ্বারোহী ও হস্তী বাহিনীর আক্রমণের জন্য পরিচালনা করেন। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী বুঝে ময়দান ছাড়তে চান জয়পাল তবে গজনীর বাহিনীর হাতে সপরিবারে বন্দি হন।
ফের বড় অংকের মুক্তিপণের পরিবর্তে ছাড়া পায়। জয়পালের পরিবার রাজ্যে ফিরে তার পুত্র আনন্দ পাল কে সিংহাসনে বসান। ক্রমাগত পড়া যার কারণে বিধ্বস্ত অপমানিত রাজা জয়পাল অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এর কিছুদিন পর গজনী, সিন্ধু অঞ্চল জয় করেন এবং ১০০৯ সালে আনন্দ পাল কে পরাজিত করে লাহোর ও মুলতান কেও নিজের অধীনস্থ করে নেয়।
হাজার বছরের অতীতে বহু যুদ্ধ হয়েছে কিন্তু বারংবার চেষ্টার এমন নিদর্শন বোধহয় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। রাজা জয়পাল পরাজিত হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু হার মানেনি। আত্মাভিমান ও স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন এক বৃহৎ শক্তির সাথে। ইতিহাস পরাজিতদের মনে না রাখলেও চেষ্টার এমন বিকল্প যুদ্ধের নিদর্শনগুলো যেতে পারে না যথাযথ কারণেই।