ঐতিহ্য,স্মৃতি,নস্টালজিয়ার মাত্রা; আমার রথযাত্রা

banner

#Pravati Sangbad Digital Desk:

 আমি মফস্বলের মেয়ে; কুলুঙ্গি,তুলসিতলা, আকাশপ্রদীপ,নৈবেদ্য,পূজার্চনা এসবের মধ্যেই আমার বেড়ে ওঠা। বাঙালীর বারোমাসে তেরো পার্বণ আমি খুব তৃনমূল স্তরে উদযাপিত হতে দেখেছি; এছাড়া পুরাণ ,আধ্যাত্মিক দিকগুলি আমি শৈশব থেকেই মানি সুতরাং রথযাত্রা উৎসবটি আমার সামনে এনে দেয় একরাশ ভালোলাগা সেই ভালোলাগা একটি ছোট শহরের বাসিন্দার নিজের ঐতিহ্য, শিকড়কে কাছ থেকে দেখার ,সেই ভালোলাগা পাঁপড়ভাজার-জিলিপির,সেই ভালোলাগা মেলায় উড়তে থাকা ধুলোর, সেই ভালোলাগা তালপাতার বাঁশির, কৃষ্ণনগরের মাটির খেলনার।
হুগলী জেলার চুঁচুড়া শহর আমার নিবাস ,অনেকেই অবগত নন খুব সম্ভবত, চুঁচুড়া ও চন্দননগর যথাক্রমে কার্ত্তিক পূজা ও জগদ্ধাত্রী পূজার জন্য প্রসিদ্ধ হলেও চন্দননগরের রথযাত্রা উৎসবও কিন্তু সুপ্রাচীন। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ ভাগে (আনুমানিক ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দ) মহাত্মা যদুবেন্দু ঘোষ কর্তৃক এই কাষ্ঠনির্মিত রথ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর বিংশ-শতাব্দীর মধ্যভাগে (সঠিক ভাবে নির্ণীত সময়কাল ১৯৬২) মেসার্স ব্রেথওয়েট অ্যান্ড কোং লিঃ (masers braithwaite and company limited) দ্বারা ভগ্নপ্রায় এই রথের ধাতব পুনর্নির্মাণ সম্পন্ন হয়। বস্তুত হুগলীর প্রসিদ্ধ রথযাত্রার খেতাব শ্রীরামপুরের ‘মাহেশের’ একচ্ছত্র নয়, যদিও এর প্রাসঙ্গিকতা প্রবন্ধের বিষয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত..... সে বিষয়ে পরে আসছি। তো এই রথযাত্রা কে কেন্দ্র করে যে মেলা তা চুঁচুড়া-চন্দননগরের মধ্যবর্তী স্থানগুলিতে বিস্তারলাভ করে; সঠিক নাম নির্ণয় না করতে পারার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী,শিকড় থেকে দূরে অনেকদিন তাতে আমার স্মৃতিশক্তি ক্ষীণ। তো যাই হোক, মেলা শব্দের অর্থ আমরা জানি এই অর্থে মিলন,কিন্তু আমার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মেলা মানে অনেক।অনেক উদারতা,অনেক সংস্কৃতি ,অনেক আনন্দ,অনেক কৃষ্টি। একদম ছোটবেলায় বাবার হাত ছিল আমার মেলায় যাওয়ার ভরসা, যে মানুষটি সবসময় চেষ্টা করে গেছেন আমায় গ্রামীণ ঐতিহ্যের সাথে পরিচয় করানোর এবং গ্রামবাংলার বা মফস্বলের সংস্কৃতি কে চেনানোর।  শিশু শুচিস্মিতা রথের মেলা মানে প্রথমে রথের রশি তানা,তারপর জিলিপি পাঁপড় ঘুগনি বুঝত, বুঝত মাটির খেলনা ,তালপাতার বাঁশী, ভেঁপু; বুঝত  ছোট্ট রথ টানা, প্রনামি-প্রসাদ। বালিকা দশম-বর্ষীয়া শুচিস্মিতা বুঝল দেবতাকে কলা-পান দেওয়া হয় বলে এক বাগধারার উৎপত্তি হল ‘রথ দেখা কলা বেচা’। কিশোরী শুচিস্মিতা বুঝল রথের মেলায় লাগতে পারে অনুরাগের রঙ ঠিক যেমন মাহেশের রথে রুক্মিণীকুমার ও রাধারানীর মনে রঙ লাগিয়েছিলেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তরুণী শুচিস্মিতা অনেক পরিণত; গ্রামীণ মেলার হস্তশিল্প,কুটিরশিল্প, মৃৎশিল্প এই দিক গুলো তাকে টানে ,ভাবায় যে এই বণিক গোষ্ঠীকে তো আরেকটু গুরুত্ব দেওয়া যায়, কিন্তু এতকিছু ভেবেও আমি সাইকেল নিয়ে পথ হারিয়ে তালডাঙার ভিতর দিয়ে অনেক কষ্টে বাড়ি এসেছিলাম।
সেই রামও নেই সেই অযোধ্যাও নেই ,নেই জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার মাসির বাড়ি প্রত্যাবর্তনে উল্টোরথের অপেক্ষা ,নেই সেই জৌলুস, সেই আন্তরিকতা; তবু এখনও আমি মেলায় যাই,জিলিপি- পাঁপড় চলে,মাটির খেলনা কিনে ঘর ভরিয়ে ফেলি,গয়না বড়ি-আচার- মোরব্বা আমার রান্নাঘরে বিরাজমান। কবিগুরু সমীপে ক্ষমা-প্রার্থী,তার কাব্য পঙক্তি টিকে একটু পুনর্গঠিত করলাম
“বাস্তবতা ভাবে আমি দেব, পরিণতমনস্কতা ভাবে আমি;
ইঁদুর-দৌড় ভাবে আমি দেব ,হাসেন আমার পরিণত-মনস্ক শিশু অন্তর্যামী”। আমার কথাটি  ফুরোলো,  অভিজ্ঞতার নটে গাছটি মুড়োলো।

Journalist Name : Suchismita Dasgupta